বাংলাদেশের সংবিধান
পর্যালোচনা
গণতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন
(মুভমেন্ট ফর পিপলস্ ল’ এন্ড কনস্টিটিউশন)
প্রকাশকাল
অগ্রহায়ন ১৪২০, ডিসেম্বর ২০১৩
প্রকাশক
গণতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন
প্রচ্ছদ
নেসার আহমেদ
কম্পোজ
সংবর্ত, ১৪ কনকর্ড এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা
মুদ্রণ ব্যবস্থাপনায়
ওয়েভ বিজনেস
২৬এ, ৭ম তলা, সাহেরা ট্রপিক্যাল সেন্টার
২১৮ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা
মূল্য পঞ্চাশ টাকা
প্রাপ্তিস্থান
বিদিত, জনান্তিক ও পড়ুয়া; আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা
চারবাক, মধ্যমা, সংহতি ও প্রকৃতি; কনকর্ড এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা
যোগাযোগ
ড. হারুন রশীদ
কক্ষ নং-২০৩০, কলাভবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Web. www.songbidhan.net
প্রাক-কথন
রাজতন্ত্রের পতন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থানের সঙ্গে ‘আইন’ -এর অগ্রগতির একটি সম্পর্ক আছে।
ইদানীংকালের কিছু গবেষণায় স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে যে, সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে বণিক পুঁজির উদ্ভব এবং পরবর্তী সময়ে তা বিকশিত হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইন একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় মনীষীগণ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখার সকল বিষয়কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে নিচ্ছিলেন তখন কেন জানি বিষয় হিসাবে ‘আইন’ তাদের তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেনি।
যদিও অ্যানার্কিস্টরা এক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যতিক্রম, কারণ তারা সকল প্রকার কর্তৃত্ব, হোক তা ঈশ্বর বা রাষ্ট্র, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছিলেন এবং সেই হিসাবে ‘রাষ্ট্র’ ও ‘আইন’ তাদের অনেকটা মনোযোগ কেড়েছিল। কিন্তু সেই মনোযোগ আইনের কর্তৃত্ব আবিষ্কার এবং সেই কর্তৃত্ব ধবংস করার প্রয়োজনীয়তার চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেহেতু অ্যানার্কিস্টরা রাষ্ট্র-সহ সকল প্রকার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছিলেন তাই তারা আইনের গণমুখী প্রয়োগ সম্ভব কি-না, বা সম্ভব হলে তার রূপরেখা কী হতে পারে, তা অনুসন্ধানের প্রয়োজনবোধ করেননি।
তখনকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে অ্যানার্কিস্টদের চাইতেও সংগঠিত অবস্থায় ছিলেন মার্কসবাদীরা। তারাও অ্যানার্কিস্টদের মতোই চেতনায় সাম্যবাদী ছিলেন। কিন্তু অ্যানার্কিস্টদের মতো শুরুতেই রাষ্ট্রকে গুঁড়িয়ে দেয়া যাবে বা রাষ্ট্রহীন উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে, এরকম চিন্তাকে তারা অবাস্তব বলে অগ্রহণযোগ্য মনে করতেন। মার্কসবাদীদের সঙ্গে অ্যানার্কিস্টদের মৌলিক বিরোধের জায়গাটি বোধহয় এটিই ছিল।
মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত দূর করতে হবে। তবে সমাজকে সাম্যবাদী স্তর পর্যন্ত পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে একটি উৎক্রমণশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং ক্রমে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে রাষ্ট্র নিজে শুকিয়ে মরে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাই শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, একটি উৎক্রমণশীল রাষ্ট্রের বা উন্নততর মুক্ত মানবিক সমাজের আইন কাঠামোটি কেমন হবে সে প্রশ্নে তারা তেমন গুরুত্ব দেননি। রাষ্ট্র যে একটি বলপ্রয়োগের সংস্থা - এ সত্যটি তারা ঠিকই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এ বলপ্রয়োগ যে শুধু সামরিক-বেসামরিক কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শারীরিক বল মাত্র নয় অথবা এ বলপ্রয়োগের ভিত্তি যে, শুধু সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র বা বিচারালয় মাত্র নয় বরং স্পষ্ট করে বললে রাষ্ট্র মানে যে, এসবের যে ভিত্তি সেই শাসনতন্ত্র বা আইন-কানুন, (যার সাথে এক ধরনের নৈতিক অনুমোদনও জড়ায়ে থাকে) মার্কসবাদীরা সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেননি। তাই উন্নততর মানবিক মুক্তসমাজের আইন-কানুনের রূপরেখাও তাদের বিশ্লেষণে স্থান পায়নি। অর্থনীতি, দর্শন এবং ইতিহাসের তুলনায় ‘আইন’-কে তারা দ্বিতীয় সারির মনে করতেন বলে বিষয় হিসাবেও আইন তাদের মনোযোগ পায়নি।
এর ফল হয়েছে অপরিমেয় ক্ষতিকর। সমাজব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্র যে অল্প সময়ের মধ্যে বিদায় নিতে বাধ্য হলো, তার অন্য অনেক কারণ থাকলেও প্রধানতম কয়েকটি কারণের মধ্যে উন্নততর ‘আইন’ কাঠামোর প্রতি নজর না দেয়া একটি বড় কারণ হিসাবে অনেক গবেষক মনে করেন।
দুই.
একট গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র) এদেশের মানুষ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রাম করেছে ও করছেন। এ লড়াইয়ে তারা গত একশ’ বছরে দুইবার ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করেছে, বহু ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কেবল গত ৪০ বছরের সংগ্রামের ধরন দেখলেই দেখা যায়, অহিংস-সহিংস, সশস্ত্র-নিরস্ত্র, নির্বাচনমুখী-নির্বাচনবিরোধী, অর্থাৎ আন্দোলন-সংগ্রামের যত রূপ থাকতে পারে, তার প্রায় সব রূপ নিয়েই এদেশের মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এবং এইসব আন্দোলন-সংগ্রামে বেশ কয়েকবার তারা শাসক শ্রেণী ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে বাধ্য করেছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই হতাশ হয়েছে, তারা বুঝতে পেরেছে যে, ব্যক্তি বা দল বা পোশাকের পরিবর্তন হলেও যে ব্যবস্থা পরিবর্তনের আশায় তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন দিয়েছে, তা অর্জিত হয়নি।
অভিজ্ঞতা হলো, দেশ ভেঙ্গে দেশ স্বাধীন করলেই, এক সরকার বিদায় করে আরেক সরকার নিয়োগ করলেই সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর হয় না, এর জন্য প্রয়োজন অগণতান্ত্রিক আইন-কানুন, বিধিব্যবস্থা বদলে নতুন গণমুখী, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক আইন-কানুন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ। এবং সেই কাজটি করতে হলে প্রথমেই চিহ্নিত করা দরকার কোন কোন আইন জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী ।
তিন.
একটি সমাজকে অনেক মানদন্ড দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। অর্থনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি
ইত্যাদি একেকটি বিষয় সমাজের নির্দিষ্ট অবস্থাকে নির্দিষ্টভাবে বুঝতে সহায়তা করে। কিন্তু ‘আইন’ দিয়েও যে একটা সমাজকে অনেক ভালোভাবে নির্দিষ্ট করে বোঝা যায়, এ বিষয়টি আমাদের সমাজ গবেষক এবং রাজনীতিকদের বিবেচনার মধ্যে নাই বললেই চলে। সমাজের বা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য যারা কাজ করেন তারা সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হন আইনের হাতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তা সত্তেও আইন নিয়ে কথা হয় সবচেয়ে কম, আইনের চরিত্র নিয়ে তো নয়ই।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৭০ এবং ’৮০-এর দশকেও একদল বামপন্থী বিপ্লবীরা কিছু কিছু আইনকে ‘কালো আইন’১ অভিধা দিয়ে এসবের অবসান দাবি করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা নাই বললেই চলে। অর্থাৎ গণতন্ত্রায়নের সংগ্রাম যে গণতান্ত্রিক আইন প্রতিষ্ঠারও সংগ্রামÑএ প্রত্যয়টি আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়া থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
চার.
দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত মিথ্যাচারগুলোর অধিকাংশই আইনকে নিয়ে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা করতে যেয়ে আমাদের মতো নবিশদেরও মনে হয়েছে, এ দেশের সংবিধান বিশেষত ’৭২-এর সংবিধান নিয়ে যে ‘মিথ’ গড়ে তোলা হয়েছে, তা ‘অনন্য’। এদেশের ডান-বাম, বিপ্লবী-অবিপ্লবী, কমিউনিস্ট, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, একাডেমিশিয়ান সবাই এই মিথে যার যার সাধ্যানুসারে যোগান দিয়েছেন।
বিপরীত মত ও দর্শনের অনুসারী হওয়া সত্তে¡ও এমনকি রাজনৈতিকভাবে পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদের মতো পরস্পরবিরোধী এবং বিপরীতমুখী অবস্থান বজায় রেখেও কার্যত রাষ্ট্র চিন্তায় যে একই বিন্দুতে থাকা যায় বা কার্যত যে একই রাজনীতিকে পরিপুষ্ট করা যায় ’৭২-এর সংবিধান প্রশ্নে এদের অবস্থান না জানলে তা স্পষ্টভাবে বোঝা যেত না।
পাঁচ.
’৭২-এর সংবিধান ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করা পর্যন্ত পাঠ এবং পর্যালোচনা করতে যেয়ে, আমরা অনেক বিষয় এবং অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, সেগুলোর সবক’টি এক মলাটে প্রকাশ করার উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি।
এটি খুবই মোটাদাগে খসড়া আকারে প্রকাশিত আমাদের প্রাথমিক পর্যালোচনা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই পর্যালোচনার বাইরে রয়ে গেছে, সেই হিসাবে এ আলোচনা অপূর্ণাঙ্গ। উল্লেখ্য যে, এদেশে গত ৪০ বছরে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম আর বহু প্রকার গবেষণা হলেও, সংবিধান নিয়ে পর্যালোচনামূলক পূর্ণাঙ্গ একটি কাজও কেউ
করার প্রয়োজনবোধ করেননি।
আমাদের এ প্রকাশনা যদি সে প্রয়োজনের প্রতি বিদগ্ধজনদের সামান্যতম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, তবে এ পরিশ্রমের অনেকটাই সার্থক হবে। পরিশ্রমের সার্থকতা বেড়ে যাবে, যদি সাধারণ পাঠক অভিনিবেশসহ খোদ সংবিধানটি পাঠ করতে আগ্রহবোধ করেন, পড়েন, নিজেরা পর্যালোচনা করেন এবং সে পর্যালোচনা তুলে ধরতে উদ্যোগী হন।
ছয়.
আমাদের সাধ্যানুসারে প্রকাশনাটিকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু চাইলেই সব হবে তাতো নয়, তাই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমাদের সব পর্যবেক্ষণের সাথে সবাই একমত হবেন এমনটি আমরা নিজেরাও আশা করি না অথবা আমাদের সব পর্যবেক্ষণে আমরা সঠিক ভাষায় সঠিকভাবে সবকিছু তুলে ধরতে পেরেছি তা হয়তো আদতেও ঠিক নয়। অবশ্য অনেক বড় বিষয়কে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরতে হলে ভাষা এবং বিষয়ের উপর যে পরিমাণ দখল, দক্ষতা এবং কুশলতা থাকা দরকার তার ঘাটতি যে আমরা পূরণ করতে পারিনি এ বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল। এতদসত্তে¡ও বিষয়ের গুরুত্ব এবং আমাদের বিদ্বৎসমাজের একাংশের একপেশেমি এবং অপরাংশের ঔদাসীন্য আমাদেরকে এ দুরূহ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। যা আমরা পারিনি, যা আমরা পারতে চেয়েছি, অন্যরা তা অনেক ভালোভাবে পারবে এই প্রত্যাশা করছি।
হাসনাত কাইয়ূম
২০ নভেম্বর ২০১৩
১. ‘কালো আইন’ একটি বর্ণবাদ আশ্রয়ী প্রত্যয়।
সংবিধান পর্যালোচনার পটভূমি
একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয়ার পর বাংলাদেশ ৪২ বছর পার করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ বহু ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সরকার ব্যবস্থা দেখার সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে য্দ্ধুকালীন প্রবাসী সরকার, যুদ্ধ শেষে সংবিধান পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার, পরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার, সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী বহুদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার, সরকারের মেয়াদ পূরণ হওয়ার পূর্বেই সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় ও প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন ব্যবস্থার সরকার, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন এবং সামরিক শাসনের অধীনে সামরিক সরকার, সামরিক সরকারের বেসামরিক সরকারে পরিবর্তিত হওয়া সরকার, সামরিক ফরমানে বেসামরিক বহুদলীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন, পুনঃসামরিক আইন, পুনঃবেসামরিককরণ, গণআন্দোলন, আন্দোলনকারী সংস্থাসমূহের অধিকাংশের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাতিল, পুনঃআন্দোলন, সংবিধান সংশোধন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল, নির্বাচন, সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই ‘রায়ের আলোকে’ সংবিধান সংশোধন, পুনরায় তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলন এবং পুনরায় সংবিধান সংশোধনের দাবি-এতসব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সুযোগ এদেশের মানুষের হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বিরল। শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে এত যে অভিজ্ঞতা ও নিরীক্ষা তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সংবিধান প্রসঙ্গ। উপরন্তু এতসব শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার মাঝেই কমবেশি সবাই একমত যে, বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘আইনের শাসন’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ‘দেশ সাংবিধানিকভাবে চলছে না’ বলে এদেশের বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল বলে কথিতদের একটি বড় অংশ অবশ্য দাবি করে থাকেন যে, ১৯৭২-এর আদি সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হবে না, জনগণের মুক্তি আসবে না।
সংবিধান নিয়ে সমসাময়িককালে রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী মহল এবং আদালতের তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা সমমনা কিছু বন্ধু-বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর বিবিধ সংশোধনীগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি এবং এর অধ্যয়ন ও পর্যালোচনায় হাত দিই।
এ কথা কমবেশি সকলেরই জানা, সংবিধান হলো জনগণের গৃহীত সেই দলিল যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং পরিচালিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের যারা নাগরিক তাদের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক কী হবে, কিরকম রাষ্ট্র কাঠামো থাকবে, সরকার পদ্ধতি কী হবে, আইন কিভাবে প্রণয়ন হবে, সেসব কিভাবে প্রতিপালন হবে, বিচার কিভাবে হবে, নির্বাচন কিভাবে হবে, সরকার বা রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় কিভাবে পরিচালিত হবে, অন্য দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক কী হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে চলবে, সম্পদের মালিকানার ধরন কী হবে, এক ধর্মের সাথে আর এক ধর্মের সম্পর্ক কী হবে, এক ভাষার সাথে অপর ভাষার জনগণের সম্পর্ক কেমন হবে, নারী-পুরুষ ও শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ কোন পদ্ধতিতে হবে, পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরন কেমন হবে-এই রকম প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী আইনসমূহ সংবিধানেই প্রধানত লিপিবদ্ব থাকে। আমাদের দেশ এবং সংবিধানও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমাদের সংবিধান আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে কতটা ধারণ করছে-সেটা খুঁজে দেখাই ছিল বর্তমান পর্যালোচনার মূল লক্ষ্য।
সংবিধান পর্যালোচনার জন্য আমরা কয়েকটি মৌলিক অবস্থান নির্ধারণ করেছি: প্রথমত, সংবিধানটিকে বুঝতে চাওয়া হয়েছে প্রধানত এদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির আলোকে। এজন্য অন্যান্য দেশের সংবিধানের সঙ্গে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি যথাসম্ভব পরিহার করার চেষ্টা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা সংবিধান পর্যালোচনার জন্য কোনো বিশেষ মতাদর্শকে আমাদের মানদন্ড হিসাবে ব্যবহার করিনি। আমরা বরং সংবিধান ঘোষিত ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং' উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বণ্টনপ্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ’ এই দুই প্রত্যয়কে মানদন্ড নির্ধারণ করে বোঝার চেষ্টা করেছি, জনগণের কোন অংশের হাতে এই মালিকানার কতটুকু কিভাবে বণ্টন করা হয়েছে।
উপরোক্ত দু’টি নির্দেশনাকে মনোযোগে রেখে আমরা সম্মিলিতভাবে সংবিধান, এর ধারণাগত বিকাশের ক্রমইতিহাস, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতি ও আইনের বিষয়গুলো পড়া ও বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রতি সপ্তাহে একবার করে মিলিত হয়েছি নিজেদের পাঠ এবং পর্যালোচনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করার জন্য এবং পরিশেষে আমাদের পর্যালোচনাসমূহকে সংক্ষেপে কয়েকটি শিরোনামে বিভক্ত করে নিজেরা এক এক অংশ নিজেদের মতো করে লিখেছি।
আমরা সংবিধানকে যথাযথভাবে বোঝার জন্য প্রথমে ’৭২-এর সংবিধান পড়েছি এবং পরবর্তীকালে সর্বশেষ সংশোধনী-সহ সবগুলো সংশোধনী পড়েছি এবং সর্বশেষ সংশোধনীসহ সংবিধান বর্তমানে যে রূপ পরিগ্রহ করেছে তা পড়েছি ধারাবাহিকভাবে। এই অধ্যয়ন ও পর্যালোচনারই সম্মিলিত ফসল এই অবস্থানপত্র। আমাদের পর্যালোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো ’৭২-এর সংবিধান ক্ষেত্রবিশেষে অপরাপর আলোচনা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। তবে আমরা একে চ‚ড়ান্ত কোনো প্রকাশনা মনে করি না এবং
এরকম একটি দুটি ছোটখাট প্রকাশনার মাধ্যমে সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা গড়ে তোলা যাবে তাও মনে করি না। তবে আমরা মনে করি সংবিধান নিয়ে জনগণের সামনে যেসব আলোচনা সচরাচর উত্থাপন করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা খন্ডিত এবং বিভ্রান্তিকর এবং এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আমাদের বিশ্বাস সংবিধান নিয়ে জনগণের ব্যাপক অংশের সাথে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক একটি সমাজ নির্মাণের সূচনা হতে পারে এইরূপ চলমান উদ্যোগের সৃষ্টিশীলতা থেকেই।
কোম্পানি শাসন
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান, যে ধরনের শাসনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা বহাল করেছে তার প্রায় সবকিছুরই সূত্রপাত ভারতে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বাণিজ্য করার জন্য ভারতে আসার পর থেকে ধাপে ধাপে বলিয়ান হয়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার মধ্যদিয়ে ব্যবসায়ী থেকে শাসকে রূপান্তরিত হয়। শাসক হবার পর থেকে কোম্পানির লুটপাট ও দুর্নীতি ভয়াবহ আকার নেয়, যার ফলে ১৭৬৯-৭০ (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পর্যন্ত এর তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং তদন্ত শেষে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘দ্য রেগুলেটিং অ্যাক্ট, ১৭৭৩’ পাস করে। একই সালে ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশদের বিচারের জন্য কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামে প্রথম সর্বোচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠা করে এবং পরবর্তীকালে রেগুলেটিং এক্টেও নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য ১৭৮৪-তে জারি করে ‘ভারত শাসন আইন’। সাধারণভাবে তাদের প্রণীত এই আইনই ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতের জন্য জন্য লিখিত আকারে একটি শাসনতন্ত্রের সূচনা বলা যায়। ১৭৭৩-এর দ্য রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুযায়ী কোম্পানিকে ২০ বছর পর পর তাদের সনদের মেয়াদ নবায়ন করতে হতো। ফলে ১৭৯৩, ১৮১৩, ১৮৩৩ ও ১৮৫৩ সালে তাদের সনদ নবায়ন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ভারতে একদিকে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে, অপরদিকে তাদের সহযোগী শক্তি গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়। ১৮১৩-এর সনদেই প্রথম ভারতে শিক্ষা বিস্তারে অর্থ বরাদ্দ করে ব্রিটিশরা।
নবজাগরণ এবং প্রতিনিধিত্বের দাবি
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর, ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান হয়, অর্থাৎ ভারতের শাসনভার কোম্পানীর বদলে ব্রিটিশ সরকার নিজ হাতে নেয় এবং তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ সালে The Government of India Act-1858 প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে ব্রিটিশ রাণীকে ভারতের রাণী এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। রাণীর পক্ষে ভারতে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ভাইসরয় এবং ভারত সচিব নামে দুইটি পদ সৃষ্টি করে একজন ব্রিটিশ মন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বরে এই উপলক্ষে এলাহাবাদে এক রাজকীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার একটি বাণী পাঠ করা হয়। এই বাণীতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বলা হয়ে ছিল, ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। এতে আরো বলা হয়, আইনের চোখে সকল ভারতবাসী সমান এবং ভারতের প্রজারা ব্রিটিশ নাগরিকের ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে।
১৮৬১ সালে ভারতে Indian Council Act -1858 পাস হয় এবং প্রথমবারের মতো ভারতীয় আইনসভায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৮৬১ সালের আইনে ভারতীয়দের আইনসভায় অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা থাকলেও নির্বাচিত প্রতিনিধির ব্যবস্থা না থাকায় ভারতবাসীর পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করার দাবি করা হয়। অবশ্য দাবিটি উত্থাপিত হয় অনেক পরে, ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখের হাত ধরে যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়, তাতে ভারতেও ব্রিটিশদের মতোই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দাবি উঠতে থাকে।
১৯০৯-১৯৩৫ কালপর্ব
বাংলায় শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার সূচনা সময়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন
১৯০৯ থেকে ১৯৩৫ এই সময়কালের মধ্যে ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯২ সালে Indian council Act পুনরায় সংশোধিত আকারে পাস হয় এবং প্রথমবারের মতো সীমিত আকারে হলেও নির্বাচন পদ্ধতির সূচনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতীয়দেরকে ব্রিটিশ সংসদীয় পদ্ধতির রাজনীতির সাথে পরিচিত এবং ব্রিটিশ পদ্ধতি অনূসরণে সক্ষম করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এই সংস্কার ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষা পুরণে যথেষ্ট ছিল না, উপরন্তু ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন করে যা হিন্দু এবং মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ১৯০৬ সালে জন্ম নেয় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে প্রথম দাবিই ছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। অপরদিকে এসময় কংগ্রেসের ভেতরে নরমপন্থী ও চরমপন্থী ধারা মাথাচাড়া দেয় এবং এ পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য তৎকালীন ভারত সচিব এবং ভাইস রয় ‘মর্লে-মিন্টো’র উদ্যোগে Indian council Act, 1892-কে অধিকতর সংস্কার করে Indian council act, 1909 পাস করা হয়। ১৯০৯ সালের আইনে ভারতের আইনসভাগুলিকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়। আইনসভা গুলিতে যে চার ধরনের সদস্য থাকতো যথা: পদাধিকার বলে সদস্য,মনোনীত সরকারী সদস্য, মনোনীত বে-সরকারি সদস্য, এবং নির্বাচিত সদস্য, সেই নির্বাচিত সদস্য আসনে প্রথম সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু করা হয়। মুসলিম সম্প্রদাযের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয় এবং যেহেতু মুসলিমরা অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল তাই তাদের ভোটাধিকার অনেক সহজ করা হয়।
ইতিমধ্যে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ-সহ কিছু পাশ্চাত্য শিক্ষিত লোক মুসলিম লীগে যোগ দেয় এবং মুসলিম লীগ তার পূর্বাবস্থানের পরিবর্তে ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে ওঠে এবং কংগ্রেসের মতো স্ব-শাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়। এই পর্যায়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৬ সালে লখনৌ সম্পাদিত চুক্তি হয়। এই চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগের পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি কংগ্রেস মেনে নেয় এবং হিন্দু-মুসলমানেরা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও ঐক্যের একটি ভিত্তি খুঁজে পায়।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের এই ঐক্য ব্রিটিশদের divide and rule নীতিকে আপাত অকার্যকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে এবং এ যুদ্ধে ভারতবাসীর অধিকতর সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে যুদ্ধশেষে ভারতীয়দের অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় দশ লক্ষ ভারতবাসীকে মিত্র সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয় ব্রিটিশ সরকার। ভারতীয়রা এ যুদ্ধে অর্থ দিয়েও সরকারকে সহায়তা করে। ১৯১৭ সালে ভারত সচিব মন্টেগু ভারত সফরে আসে এবং ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ডস চেমসের সাথে অলোচনাক্রমে একটি রিপোর্ট করেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ সালে Government of India act, 1919 পাস হয়। এই আইনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো-এই আইনে বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন থাকবে। এই আইনে প্রথম ইংল্যান্ডে হাই কমিশনার পদ সৃষ্টি করা হয়, কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠন করা হয়। নিম্নকক্ষকে Central Legislative Assembly আর উচ্চকক্ষকে Council of States বলা হতো। এই আইনের মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদান করা হয়, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদে প্রত্যক্ষ ভোটে (যদিও ভোটাধিকার সীমিত) প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়।
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচন হয় ১৯২৩ সালে। ১৯২১ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনবার এ নির্বাচনসমূহ অনুষ্ঠিত হয় এবং এ সময়ে প্রাইমারি এডুকেশন বিল, বঙ্গীয় প্রজাখাতক আইন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন ইত্যাদি পাস হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবাসীর সমর্থন লাভের জন্য ব্রিটিশরা ভারতবাসীকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার মধ্যে স্বাধিকারের স্বীকৃতিও ছিল, কিন্তু ১৯১৯-এর আইনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। উপরন্তু ভারতে হিন্দু-মুসলানদের সা¤প্রদায়িকভাবে বিভক্ত করে ভারত শাসনকে প্রলম্বিত করার যেসব পদক্ষেপ ব্রিটিশ সরকার সে সময় নিয়েছিল ভারতবাসীকে তা বিক্ষুব্ধ করে তুলছিল। এ সময়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব, রাশিয়াতে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল ইত্যাদি ভারতের জনগণের মাঝে স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তুলছিল। একদিকে জনগণ যেমন রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং সক্রিয় হয়েছিল-অপরদিকে ব্রিটিশরাও একের পর এক আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। রাওলাট আইন পাস, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন, মওলানা শওকত আলি-মুহাম্মদ আলির খিলাফত আন্দোলন, চিত্তরঞ্জন দাস ও মতিলাল নেহেরুর স্বরাজ দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ প্রভৃতি ১৯১৯-এর আইনের অধিকতর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে তুলেছিল।
১৯২৮ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল দিল্লিতে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে মিলিত হয় এবং সেখানে সর্বসম্মত একটি শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয় এবং মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে সে লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলে মুসলিম লীগ তার কিছু সংশোধানী প্রস্তাব পেশ করে কিন্তু সে প্রস্তাবসমূহ কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯২৯ সালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স হয় এবং সেখানকার প্রস্তাবের আলোকে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৪ দফা দাবি প্রণয়ন করেন। এতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে আবার বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সাম্প্রদায়িক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে, প্রথমে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করলেও পরে এতে যোগ দেয় এবং উক্ত গোলটেবিল আলোচনার প্রেক্ষিতেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম ছিল একটি সর্বভারতীয় ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র গড়ার প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইনসভার স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা বহাল রাখা (অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মাবলম্বী স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান) ইত্যাদি।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গে ৪টি মন্ত্রীসভা ক্ষমতাসীন হয়েছিল। এ. কে. ফজলুল হক দুইবার, খাজা নাজিমুদ্দিন একবার, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার এসব মন্ত্রীসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস হওয়ার পর কেবল এর প্রাদেশিক অংশটিই কার্যকর হয়েছিল।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারতের মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য দাবি তোলা হয়। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ মন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারত সফর করেন এবং ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য একটি প্রস্তাব করেন, যা ইতিহাসে ক্রিপস মিশন হিসাবে খ্যাত। এর প্রস্তাবগুলোতে ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সুযোগ এবং যুদ্ধ শেষে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয় দলই তাদের অবস্থান থেকে এ প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪২ সালে কংগ্রেস ও সোসালিস্ট পার্টি ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করলে ব্রিটিশ সরকার এই উভয় দলের ওপর দমনপীড়ন শুরু করে। তাদের অজস্র নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা কোনো মতৈক্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।
১৯৪৬ সালে ব্রিটেনে ‘লেবার পার্টি’ বিপুল ভোটে জয়ী হলে অ্যাটলির নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। অ্যাটলি ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন এবং এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তিনজনের একটি মিশন ভারতে আসে। এ মিশন ভারতীয় ইউনিয়নের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের সুপারিশ করে। ১৯৪৬ সালে প্রদেশগুলোর নির্বাচনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে, মুসলিম লীগ পাকিস্তান গঠনের ব্যাপারে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের ডাক দিলে কংগ্রেস তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। ফলে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়, যা ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে অ্যাটলি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য ভারতের ভাইসরয় হিসাবে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে নিয়োগের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয়।
মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের যে রূপরেখা তৈরি করেন তার বৈশিষ্ট্য ছিলঃ
-সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব ভারতীয়দের নির্বাচিত গণপরিষদের ওপর হস্তান্তর;
-ভারত অখÐ রাখার জন্য আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ ব্রিটিশ সরকার নেবে না বলে ঘোষণা প্রদান;
-কোনো অঞ্চল ইতিমধ্যে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে নতুন গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা;
-বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির ব্যবস্থা রাখা এবং এই বিভক্তির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণের একটি সীমানা কমিশন গঠন ইত্যাদি।
এবং
-এসব কার্যাবলী সম্পন্ন হলে ক্ষমতা হস্তান্তর।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই The Indian Indepence Act-1947 পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষকে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দু’টি স্বাধীন ডোমিনিয়নে বিভক্ত করা হয়। নতুন সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ডোমিনিয়নের সরকারসমূহ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী পরিচালিত হবে বলে নির্ধারিত হয়। ১৯৩৫ সালের আইন প্রয়োজনে পরিবর্তনের ক্ষমতা ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের হাতে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্ধারিত হয় এ মেয়াদের পর থেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করবে গণপরিষদ। সকল সরকারি কর্মচারি ও সশস্ত্র বাহিনীকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। জিন্নাহ পাকিস্তান ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৪ আগস্ট করাচিতে উপস্থিত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।
দু’শ বছরের শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা এভাবে অতিসংক্ষেপে তুলে ধরার পর যে জরুরি বিষয়টি উল্লেখ করা বিশেষ প্রাসঙ্গিক তাহলো, স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান কিন্তু শুধু ব্রিটিশদের প্রণীত সংবিধানের অধীনেই যাত্রা শুরু করেনি, ব্রিটিশদের প্রণীত যাবতীয় আইনও তার সঙ্গী হয়েছিল, যেসব আইন তৈরি হয়েছিল প্রধানত উপনিবেশের জনগণকে ‘শাসন’ করার জন্য। কিন্তু নতুন ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রদ্বয়ও ওইসব আইনকে ধারণ করে নিয়েছিল তার নিজ নিজ ‘স্বাধীন’ সত্তায়।
স্বাধীন সত্তায় উপনিবেশিক ধারাবাহিকতা
ব্রিটিশরা অনেক আইন করেছিল। যার অধিকাংশই ছিল মৌলিক চরিত্রের। প্রত্যেকটি আইনের প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। এগুলোর মধ্যে-
-১৭৭৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন;
-১৮৬০ সালের Penal Code
-১৮৬১ সালের Police Act
-১৮৭২ সালের Evidence Act
-১৮৭৮ সালের Arms Act
-১৮৯৮ সালের The code of criminal procedure
-১৯০৮ সালের Code of civil procedure-এরকম অনেক।
১৯১০ সালের মধ্যে ভারতের আইনগত কাঠামোকে পুরোপুরি ব্রিটিশদের মডেলে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
উপরোক্ত আইনি ধারাবাহিকতার পাশাপাশি এখানে এ-ও মনে রাখতে হবে, ১৭৬৩-এ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পর ১৭৭৩-এ কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে, প্রথমে নিজেদের জন্য, যা পরবর্তিতে বিস্তৃত হয় ভারতীয়দের জন্যও। এটা ছিল উপরোক্ত আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি একটি বিচার-ব্যবস্থার বিস্তার, পরে তা বিস্তৃত হয়েছে ধাপে ধাপে সর্বনিম্ন স্তর থানা পর্যায়ে মুন্সেফ আদালত পর্যন্ত। আর ১৭৯৩ সালেই আদালতকে ‘সহায়তা’ করার জন্য আইনজীবীদের সনদ দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। অর্থাৎ ব্রিটিশরা যখন ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছে তখন শুধু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বা Indian Indepence Act দিয়ে যায়নি, তাদের উপযোগী আইন, আর বিচারব্যবস্থাও দিয়ে গেছে। আরো বেশি দিয়ে গেছে তাদের অনুসরণ করার শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা।
উপরোক্ত শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ও আইনগত কাঠামো নিয়েই পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয়। একদফা ‘স্বাধীনতা’র স্বাদ পেল তারা। কিন্তু একই সঙ্গে সংগ্রাম ও নির্মাণের নতুন কালও শুরু হলো।
বাঙালির সংবিধান তৈরির সংগ্রাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ববাংলা ২৩ বছর পাকিস্তানের কাঠামোতে ছিল। এই পুরো সময়টা ছিল বস্তুতপক্ষে একটি সংবিধান তৈরির সংগ্রামের সময়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনার সময় অনেকেই সংবিধানের জন্য সেই সংগ্রামের কথা বাদ দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংগ্রামের আলোকেই পুরো ঘটনাবলিকে পর্যালোচনা করে থাকেন।
ব্রিটিশ নির্বাচিত প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন শুরুতে। এতে দেশে, বিশেষত পূর্ববাংলায় গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসলেও ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তার বক্তব্য স্থানীয়দের বিক্ষুব্ধ করে তুলে। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে সাংবিধানিক অগ্রগতি ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে গণপরিষদ কর্তৃক নতুন সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের উপরোক্ত অ্যাক্টের আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে ঐকমত্য ছিল। সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৪৬-তে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন অথবা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন গণপরিষদ নির্বাচিত করে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়ার কথা ছিল। ১৯৩৫-এর শাসনতন্ত্রের আরেকটি বড় বিষয় ছিল সেখানে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা, অর্থাৎ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রদেশের সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে ক্ষমতার ভাগাভাগির রূপরেখা তৈরি করাই ছিল। আশা করা যাচ্ছিল যে, ১৯৩৫-এর শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান প্রণয়ন হয়তো দুরূহ হবে না, কিন্তু ক্রমে সে আশাবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের ৭ বছরে মাত্র ১৬টি অধিবেশন হয়। এর মধ্যে ১৩টি হয় জরুরি কিছু আইন প্রণয়নের জন্য।
ক্ষীণ শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি
মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮-এর ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কোনো অগ্রগতি ছিল না। তার মৃত্যুর পর তমিজউদ্দিন খান গণপরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হলেন এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের উদ্যোগে প্রথম সংবিধান প্রণয়নের জন্য Objective Resolution গৃহীত হয়।
এই প্রস্তাবে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হিসাবে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে আইন প্রণয়ন ও একটি ধর্মভিত্তিক ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চর্চার প্রস্তাবের সঙ্গে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের কথাও বলা হয়। পাকিস্তানের সকল অঞ্চলসমূহকে নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সকল ইউনিটসমূহকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার প্রস্তাব করা হয় এ রিপোর্টে। এ রিপোর্ট পাস হওয়ার পর মূলনীতি নির্ধারক কমিটি গঠন করা হয়। মূলনীতি নির্ধারক কমিটি কাজের সুবিধার্থে স্টিয়ারিং কমিটি ও কয়েকটি সাব-কমিটি গঠন করে। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান গণপরিষদে একটি অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করলে তৎকালীন পূর্ববাংলায় এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। মূলত ফেডারেল ব্যবস্থাকে দুর্বল করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবের কারণেই এই আন্দোলনের শুরু।
অক্টোবরে পূর্ববাংলায় রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিকদের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন সংগ্রাম কমিটি’ (কমিটি অব অ্যাকশন ফর ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন) গঠিত হয়। কমিটির ডাকে ৪-৫ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ঢাকায় এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্মেলন থেকে মূলনীতি কমিটির প্রস্তাবের বিপরীতে একটি খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়, সেখানে দাবি করা হয়, রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র; যার দু’টি অংশ থাকবে এবং এটি হবে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে একটি এক-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ থাকবে। সংসদের সদস্যরা কোনো লাভজনক পদে আসীন হতে পারবে না। প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের তাদের সংসদ সদস্যকে সংসদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে। মন্ত্রীসভা তার কাজের জন্য সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু। পূর্ব এবং পশ্চিমের জন্য দু’টি প্রাদেশিক সরকার থাকবে এবং পশ্চিম অঞ্চলে যেহেতু অনেক প্রদেশ আছে তাদের সরকার পদ্ধতি তারা সম্মেলন করে ঠিক করবে।
মৌলিক অধিকার প্রশ্নে বলা হয়, হাইকোর্টের হেবিয়াস কর্পাস ক্ষমতা বন্ধ করা যাবে না, শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয় ও বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষকে শোষণ করবে এমন আইন প্রণয়ন করা যাবে না। উপরোক্ত খসড়া শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবের পক্ষে ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব-সহ অপরাপর প্রধান নেতারা জেলে থাকলেও স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২১ নভেম্বর ১৯৫০-এ লিয়াকত আলি খান এ পরিস্থিতিতে তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের আগস্টে সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করে খাজা নাজিমউদ্দিন তা গণপরিষদে পেশ করেন।
আইন পরিষদে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সমান প্রতিনিধিত্বের কারণে এ প্রস্তাব পূর্ববাংলার জনগণ মেনে নেয়নি। ১৯৫৩-তে পাঞ্জাবে দাঙ্গার কারণে খাজা নাজিমুদ্দিন পদত্যাগ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। তিনি সমগ্র পাকিস্তানকে দুইটি ইউনিট হিসেবে ভাগ করার প্রস্তাব দেন যা মোহাম্মদ আলীর প্রস্তাব বা ‘মোহাম্মদ আলী ফর্মুলা’ বলে পরিচিত। এ প্রস্তাব দ্ইু অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য এনে দেয়। এ ফর্মুলায় পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ ইউনিটের বদলে ৪টি প্রদেশ প্রস্তাব করা হয়। উচ্চ-কক্ষে ৫টি প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। নিম্ন-কক্ষে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা নির্ধারণের সুযোগ রাখা হয় এবং উভয়কক্ষে মোট আসন সংখ্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে সমান রাখা হয়। এটাও ঠিক করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান যদি এক অংশের হয় তবে প্রধানমন্ত্রী হবেন অন্য অংশ হতে। কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হলে উভয়কক্ষের যৌথসভায় মীমাংসা হবে। রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু।
মোহাম্মদ আলী ফর্মুলার ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্ট ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে ২৯-১১ ভোটে গৃহীত হয়। এই রিপোর্টে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলা হয়। জাতীয় সংসদকে সার্বভৌম করা হয় এবং গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা কিছু পরিমাণে হ্রাস করা হয়। মন্ত্রী পরিষদ গঠন ও ভেঙে দেয়ার ‘ক্ষমতা’ গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করার প্রস্তাব থাকায় গভর্নর জেনারেল এক অধ্যাদেশ বলে গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন। গণপরিষদের সভাপতি তমিজ উদ্দিন খান সিন্ধু হাইকোর্টে এ আদেশ চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট গণপরিষদের পক্ষে রায় দিলেও সুপ্রিম কোর্ট তা বহাল রাখেনি। এভাবেই পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি এক দফা ভেস্তে যায় এবং পূর্ববাংলার জন্য তা বিশেষ হতাশার কারণ হয়ে দেখা দেয়।
ইতিমধ্যে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে আবার তাকেই মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানানো হলে তিনি বিনা প্রতিবাদে তাতে যোগ দেন। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং প্রধান সেনাপতি আইয়ূব খান মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। মন্ত্রীসভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও যোগ দেন। ’৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় যুক্তফ্রন্টের কাছে। ৪০ আসনের মধ্যে ৩৯টিতে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা। এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্তফ্রণ্টের মূল নেতৃত্ব।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ও ’৫৬-এর সংবিধান
শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে জমিদারী প্রথা বিলোপের দাবি ছাড়াও অন্যতম ছিল মুদ্রা, পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া কেন্দ্রের হাতে অন্য কোনো ক্ষমতা না রাখার দাবি। মোহাম্মদ আলী মন্ত্রীসভার সাতজন সদস্য গণপরিষদে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হলে কেবিনেট পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে চলে যান। ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রদূতের চাকরি থেকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন (সম্পূর্ণ একই পরিস্থিতি না হলেও বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়া এবং আবার বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে এ বিষয়টি তুলনীয়)। নির্বাচনের পর দ্বিতীয় গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বসে ৭ জুলাই ১৯৫৫। ৮ সেপ্টেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিট ধরে একটি বিল পাস হয় এবং পূর্ববাংলার নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়। ১৯৫৬ সালের ৮ জানুয়ারি সংবিধানের খসড়া প্রকাশ করা হয়। আওয়ামী লীগ ২১ দফার ভিত্তিতে সংবিধান না হওয়ায় তা না মানার হুঁশিয়ারি দেয়। মওলানা ভাসানী এমনকি ‘আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে’ বলেও হুমকি দেন। আর আবুল মনসুর আহমদ ‘ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের উভয় অংশের কোনো মিল নাই’ বলে বক্তব্য দেন।
সংবিধানের খসড়া গণপরিষদে উত্থাপিত হলে আওয়ামী লীগ এতে ৬৭০টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং তাদের প্রস্তাবগুলো উপেক্ষিত হলে তারা অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসে। মুসলিম লীগ, কে.এস.পি এবং নেজামে ইসলামীর কোয়ালিশন সরকার ‘সার্বভৌম ইসলামি প্রজাতন্ত্র’র সংবিধান পাস করে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬-তে, আর তা কার্যকর হয় ২৩ মার্চ। ২৩ মার্চকে তাই পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করা হয়।
এ সংবিধানে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাখা হয়। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুকরণে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া হয়। নারীদের জন্য ১০টি অতিরিক্ত আসন দশ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। জাতীয় সংসদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমান প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়। বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও ব্যাখ্যাদাতার ক্ষমতা দেয়া হয়। সংবিধান পরিপন্থী আইন বাতিল করার ক্ষমতাও দেয়া হয় সুপ্রিম কোর্টকে।
কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরের চেষ্টায় যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তার আয়ু ছিল মাত্র ২ বছর। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। সংবিধান বাতিল ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করা হয়। এইভাবে একটি সাংবিধানিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। পাকিস্তান আবার সংবিধান ফিরে পাওয়ার পুরানো সংগ্রামে ফিরে যায়, সঙ্গে পূর্ববাংলাও।
১৯৬০ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেন এবং একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ উদঘাটনের এবং ভবিষ্যতের সংবিধানের সুপারিশ প্রণয়ন করার।
কমিশন পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে রিপোর্ট প্রদান করে এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অভিমত দেয়। কেন্দ্রের হাতে কেবল মুদ্রা, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক দায়িত্ব রাখার ধারণার বিপক্ষে কমিটি মতামত দেয়। সর্বোপরি কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পাকিস্তানের জনগণ সেদেশের প্রেসিডেন্ট এবং আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করার যোগ্য নয় সেজন্য উচ্চপদসমূহের নির্বাচনে ভোটদানের ক্ষমতা সীমিত করা উচিত। এভাবে কমিশন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করে।
কমিশন মার্কিন ধরনে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সুপারিশ-সহ দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করে। পাকিস্তানের এক অংশ থেকে প্রেসিডেন্ট এবং অপর অংশ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ করে। এই রিপোর্ট প্রেসিডেন্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বাতিল করে দিয়ে সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপর একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির খসড়া প্রণয়ন শেষ হলে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট সংবিধান ঘোষণা করেন এবং ৮ জুন থেকে তা কার্যকর হয়।
৬২ সালের সংবিধান
১২টি ভাগে বিভক্ত এ সংবিধানে ২৫০টি অনুচ্ছেদ এবং ৩টি তফসিল ছিল। প্রস্তাবনায় ইসলামি সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা ছিল। মৌলিক অধিকার অংশে বলা হয়েছিল রাষ্ট্র ইসলাম পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির ব্যবস্থা রাখা হয় এবং প্রেসিডেন্টকে করা হয় অগাধ ক্ষমতার অধিকারী। বিচার বিভাগের ক্ষমতা অতিমাত্রায় সংকুচিত করা হয়। হেবিয়াস কর্পাসসহ মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে বিচার বিভাগের প্রায় কোনো ক্ষমতাই ছিল না। নির্বাচনী অধিকারও ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর নামে খর্ব করা হয়। প্রাদেশিক সরকারের নির্বাহী করা হয় প্রেসিডেন্ট মনোনীত গভর্নরকে। গভর্নরকে সহায়তার জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ ছিল। প্রত্যেক প্রদেশে এক-কক্ষবিশিষ্ট একটি আইন পরিষদ ছিল। কিন্তু আইন পরিষদের বিলে গভর্নরের সম্মতির প্রয়োজন ছিল। তিনি বিলে সম্মতি দিতে বা ফেরত দিতে পারতেন, জাতীয় পরিষদে প্রেরণ করতে পারতেন এবং অধিবেশন স্থগিত থাকাকালীন অধ্যাদেশ জারি করতে পারতেন।
আইয়ুব খানের এ সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ আসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে। ছাত্ররা সংবিধান বাতিল ও গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে প্রায় বছরব্যাপী ধর্মঘট, প্রতিবাদ মিছিল, সংবিধানের কপিতে আগুন দেয়ার মতো কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে।
পূর্ববাংলায় ছাত্র গণবিক্ষোভ, গণঅভ্যুত্থান ও নির্বাচন
এ সময়কালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ছাত্রদের ব্যাপক মাত্রায় আইয়ুব-বিরোধী করে তুলে। আইয়ুব খান তার ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে ছাত্রদের নামে কুৎসা, ছাত্র রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার শুরু করেন। ছাত্রদের নামে হুলিয়া জারি এবং বহু ছাত্র নেতা ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় প্রায় সকল নেতা রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন এবং রাজনৈতিক নেতারা সংবিধান বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করতে শুরু করেন। ’৬২-এর ২৫ জুন নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী, মোহন মিয়া, মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক এবং মোছলেহ উদ্দিন দুদু মিয়া এক বিবৃতিতে ’৬২-এর সংবিধানের বিরোধিতা করে ফেডারেলধর্মী নতুন সংবিধানের দাবি করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ৯ নেতার সমর্থনে বিবৃতি দেন। এরপর আসে ১৯৬৬-র ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা। শুরু হয় পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিভিন্ন আন্দোলন। পরিস্থিতি ক্রমে একটি গণঅভ্যুত্থানের দিকে যায় এবং ১৯৬৯-এর ২৪শে মার্চে গণঅভ্যুত্থানের পর ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের নিকট থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যতশীঘ্র সম্ভব প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশের সংবিধান প্রণয়ন। এই ঘোষণার পাশাপাশি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ব্যবস্থা বাতিল করে ৪টি প্রদেশ সৃষ্টি করেন। ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে ঘোষণা করা হয়, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় পরিষদের কাজ হবে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চে এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান উক্ত নির্বাচনের ‘আইনি কাঠামো’-র (Legal Framework Order-LFO) মূল দিকগুলো ঘোষণা করেন।
এল.এফ.ও’র প্রধান প্রধান দিক ছিল ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসন বণ্টন এবং সেভাবে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের ১৬২টি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, আর ১৫৮টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি আসনের ৭টি পূর্ব পাকিস্তানের এবং ৬টি পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল। প্রাদেশিক পরিষদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আসন ৩০০টি, পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশে ৩০০টি, সংরক্ষিত আসন হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে নারীদের জন্য ১০টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১১টি আসন রাখা হয়। ১৯৬৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন এমন লোকদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
এছাড়া উল্লিখিত আদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, নির্বাচন শেষে প্রেসিডেন্ট তার পছন্দমতো দিন, সময় ও স্থানে অধিবেশন আহ্বান করবেন। অধিবেশন শুরুর ১২০ দিনের মধ্যে পরিষদ শাসনতন্ত্র বিল নামক বিলের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং তা করতে ব্যর্থ হলে পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর তা প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। শাসনতন্ত্র অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ কাজ করবে ‘আইন পরিষদ’ হিসাবে। শাসনতন্ত্র বিলে প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দিলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আর শাসনতন্ত্র বিলে অনুমোদন দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা যাবে না। এল.এফ.ও’র কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে তা করবেন প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট এল.এফ.ও’র যে কোনো ধারা সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের হস্তক্ষেপমূলক কোনো ক্ষমতা থাকবে না। উপরন্তু, শাসনতন্ত্রে কী কী থাকতে হবে তার কিছু কিছু বিষয়ও আগে থেকেই নির্ধারিত করে দেয়া ছিল এ আইনে।
ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষণার ব্যাপক সমালোচনা করে ন্যাপ ভাসানী এবং ন্যাপ (ওয়ালি)। এল.এফ.ও থেকে অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে ২৬ এপ্রিল দাবি দিবস পালন করে ন্যাপ (ওয়ালি)। ন্যাপ ভাসানী এই নির্বাচন বর্জন করে প্রধানত দুটি দাবিতে।
এক. জাতীয় সংসদে কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য আসন নির্দিষ্ট করতে হবে।
দুই. নির্বাচনের আগে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন মীমাংসা করতে হবে।
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। আর প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টির মধ্যে ২৮৮টি পায় তারা। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৬৪ আসনের মধ্যে ৮৮টি পায় ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস্ পার্টি।
নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্তে¡ও অধিবেশন আহ্বানের ক্ষেত্রে টালবাহানা শুরু করে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেও ভুট্টোর চাপে তা স্থগিত হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে দেশ কার্যত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনাধীনে চলে আসে। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। ১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চলে। ২৩ মার্চে ভুট্টো ঢাকায় আসেন আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পশ্চিমা সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। আলোচনা ভেঙ্গে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ এম.এ. হান্নান এবং ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
১ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করেন এবং ৬ এপ্রিল ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসাবে তাজউদ্দিন আহমদ নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দেন। পরে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট দেখিয়ে একটি সরকার গঠন করেন। ১০ এপ্রিল রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার একটি ভাষণ প্রচার করা হয় এবং তিনি সেই ভাষণে ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে দাবি করেন। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বর্ণনা করতে যেয়ে তিনি বলেন: “বাংলাদেশের নিরস্ত্র দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক একটি নতুন পৃথিবী যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্ব নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর-বাঙালি ভাই-বোনের সম্মিলিত মনোবল, অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তি প্রস্তাবে লেখা হোক, জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ।”
১০ এপ্রিলের বেতার ভাষণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ শীর্ষক দু’টি দলিলকে ১০ এপ্রিলে প্রকাশিত হিসাবে দেখানো হয়। ১৭ এপ্রিলে মুজিবনগরে (মেহেরপুরের আম্রকুঞ্জে) বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এভাবেই বাংলাদেশ তার স্বতন্ত্র সাংবিধানিক একটি প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। মূলত ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ঐ ঘোষণাপত্রটিই ছিল বাংলাদেশের সংবিধান।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিতে বলা হয় ’৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে নির্বাচিত করেছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করে একটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করেন। তৎপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সেখানে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বিবৃত করা হয়েছে এভাবে: “যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি। এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাও অনুমোদন করছি।”
এছাড়া এ ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নসহ সকল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী করা হয় প্রেসিডেন্টকে। পরবর্তী সংবিধান গৃহীত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত এ ঘোষণাপত্রকেই সংবিধান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জন করার পর ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দেশে আসার পরদিনই অর্থাৎ ১১ জানুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে সকল প্রকার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। নতুন আদেশে তা পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে বলা হয় প্রেসিডেন্ট তার সকল কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন। অস্থায়ী সংবিধানে অপরাপর বিষয়ের সঙ্গে Constituent Assembly-র একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়। যার মূল বিষয় ছিল এটা মূলত আইনসভা হিসাবে কাজ করবে।
অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের পরদিন ১২ জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন।
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চে Constituent Assembly Order জারি করা হয়, এবং এটিকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়। আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ এবং Constituent Assembly Order অনুযায়ী যে সমস্ত আইন ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল, তার সবই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বলবৎ থাকবে বলে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে Constituent Assembly গঠনের ঘোষণা করা হয়।
একই দিনে অর্থাৎ ২৩ মার্চে অপর একটি আইন The Bangladesh Constituent Assembly members (Ceassation of Membership) Order-১৯৭২ জারি করা হয়। যা ছিল মূলত গণপরিষদের সদস্যপদ খারিজ সংক্রান্ত।
প্রথমোক্ত আইনটিতে Constituent Assembly-কে শুধু Constitution প্রণয়নেরই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এর বাইরে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের ছিল না। দ্বিতীয় আইনটিতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়, যদি কোনো গণপরিষদ সদস্য তিনি যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন সে দল থেকে পদত্যাগ করেন বা দল তাকে বহিষ্কার করে তবে তার সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে এবং এ বিষয়ে কোনো আদালত-এ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
এ দুটি আদেশ জারির পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৯ এপ্রিল সংসদীয় দলের নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়। ১০ এপ্রিল গণপরিষদের উদ্বোধন হয়। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে আহবায়ক করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। ন্যাপ থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ কমিটিতে একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন। ১০ জুনের মধ্যে সংবিধানের খসড়া গণপরিষদে উপস্থাপন করতে বলা হয়। ১৭ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। এ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহŸান করা হয়। ৮ মে’র মধ্যে ৯৮টি প্রস্তাব পাওয়া যায়। ১০ জুনের মধ্যে কমিটি খসড়া তৈরি করতে সক্ষম হয়। সংবিধানকে ‘পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর’ করার জন্য ড. কামাল হোসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করেন। এছাড়া একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। ১১ অক্টোবর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৩ অক্টোবর পরিষদের কার্যপ্রণালী বিধিমালা গ্রহণ করা হয়। ১৮ অক্টোবর থেকে সংসদে সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর সমাপ্ত হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদওয়ারি আলোচনা চলে। ৪ নভেম্বরে সংবিধান বিল পাস হয়। ১৪ ডিসেম্বরে গণপরিষদ সদস্যগণ এতে স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বরকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তন সত্যিই ইতিহাসে বিরল। বিশেষত পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় এ অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সংবিধানটি সুলিখিতও বটে। ১১টি অধ্যায়ে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিলে বিভক্ত এ সংবিধান। রাষ্ট্রের চরিত্র যে গণপ্রজাতান্ত্রিক, সংবিধান যে দেশের সর্বোচ্চ আইন, জনগণই যে সকল ক্ষমতার মালিক, জণগণের অভিব্যক্তির প্রকাশই যে সংবিধান, প্রজাতন্ত্রের লক্ষ্য যে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় সরকারই যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে, বিচার বিভাগ যে স্বাধীন থাকবে, এর প্রায় সবই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ সংবিধানে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন, কর্ম কমিশন, ন্যায়পাল ও মহা হিসাব-নিরীক্ষক ইত্যাদি যে সাংবিধানিক সংস্থা হবে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন যে বিচার বিভাগ বাতিল করতে পারবে, এ রকম অনেকগুলো মৌলিক প্রশ্নে রাষ্ট্র তার অবস্থানের কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে এ সংবিধানে।
এছাড়া রাষ্ট্র তার মূলনীতি হিসাবে, “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়পরায়ণ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা”, “মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’’, “ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা’’, “মেহনতী কৃষক-শ্রমিকের শোষণ মুক্তি”, ‘‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সহ কর্ম বিশ্রাম ও বিনোদনের অধিকার প্রতিষ্ঠা’’, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকলের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টির অঙ্গীকার এই সংবিধান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির জন্য অঙ্গীকার ঘোষণা করছে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তির অনুপার্জিত আয় ভোগ করার সামর্থ্য থাকবে না এবং সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন দানের বিষয়কে রাষ্ট্র তার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে।
এছাড়া সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির পাশাপাশি কতিপয় অধিকারকে নাগরিকের ‘মৌলিক অধিকার’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এইসব অধিকার লঙ্ঘিত হলে হাইকোর্টে মামলা করার বিধান রাখা হয়। বলা হয়, এসব অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না এবং যদি তেমন কোনো আইন বিদ্যমান থেকেও থাকে তবে তার যতটুকু মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসমঞ্জস ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে। এইসব মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হলো চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা, সকলের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং সকলের সমানভাবে বিচার পাওয়ার অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি।
উপরে যে বিষয়গুলো নিয়ে বলা হয়েছে তার প্রায় সবকিছুরই উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং প্রথম থেকে তৃতীয় অধ্যায়ের মধ্যে। একজন পাঠকের স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে, পরবর্তীকালে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, যদি তা না করা হতো তাহলে আমাদের সংবিধান একটি উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসাবে বিবেচিত হতে পারতো। আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে ধরনের সংবিধান রচিত হবে বলে মানুষ বিশ্বাস করতো, উপরোক্ত ৪টি অধ্যায়ে তার অনেক কিছুরই উল্লেখ আছে এবং এজন্য এখনো এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেই মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ অনেকখানি সুগম হবে।