বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা – ২য় অংশ

প্রথম অংশের পর...

সংবিধানের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য
উপরে যে বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণভাবে একটি সংবিধানে এইসব বিষয়ের নিশ্চয়তা থাকলে, তাকে মোটামুটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসাবে মেনে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, সংবিধানটি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে যে কারো চোখেই ধরা পড়বে যে, উপরে যেসব অধিকারের বিবরন দেয়া হয়েছে কার্যত সংবিধান এবং অপরাপর আইন যেন তার বিপরীত অবস্থান নেয় তার পথও এই সংবিধানে খুবই দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ এবং নির্ধারণ করা হয়েছে। এককথায় বলা যেতে পারে, এটি একটি গোলক ধাঁধাঁর মতো। ‘প্রদত্ত’ যেকোনো অধিকারের হাত ধরেই আপনি সংবিধানের ভেতরে প্রবেশ করুন না কেন, শেষতক সে আপনাকে পাকিস্তান বা আরো সত্য করে বললে পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
বিষয়গুলোকে খোলাসা করার জন্য আমরা সংবিধানটিকে কয়েকটি প্রশ্ন আকারে বিভক্ত করে আলোচনা উত্থাপনের চেষ্টা করবো; যেমনÑ জনগণের ক্ষমতার প্রশ্ন, রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের প্রশ্ন, আইন-কানুনের চরিত্রের প্রশ্ন, নারী-পুরুষের সমতার প্রশ্ন ইত্যাদি।

ক্ষমতার মালিক জনগণ তবে প্রয়োগের মালিক প্রধানমন্ত্রী!
প্রথমেই ধরা যাক, ‘ক্ষমতা’র প্রশ্নটি; সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি অর্থাৎ ইচ্ছার প্রতিফলন এবং এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা নাগরিকের ‘পবিত্র দায়িত্ব’ এবং সেই সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৭(১) বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।” লক্ষ্যণীয়, বাক্যটি এখানে শেষ হয়নি, বাক্যের মধ্যে একটি ‘;’ চিহ্ন দিয়ে বলা হচ্ছে ‘এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ, কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’। পুরো অনুচ্ছেদটি পাঠ করলেই বোঝা যায়, ক্ষমতার মালিকানা জনগণের হলেও প্রয়োগের মালিকানা নিয়ে কিছু নির্দেশনা আছে এবং তা এই সংবিধানেই দেয়া আছে। সংবিধানটি একটু ভালোভাবে দেখলে দেখা যাবে, মূলত চতুর্থ ভাগ থেকেই নির্দিষ্টভাবে এই ক্ষমতা, অর্থাৎ ‘জনগণের ক্ষমতা’-কে, কতটা, কিভাবে ভোগ করবে তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
সংবিধানের চতুর্থ ভাগ হলো, নির্বাহী বিভাগ। এ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদ রাষ্ট্রপতি সম্পর্কিত। এ অধ্যায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, তার পদের মেয়াদ, তার দায়মুক্তি, অভিসংশন, ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার ইত্যাদির বিবরণ দেয়া আছে। তার মধ্যে প্রথম দিকেই অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এ বলা হচ্ছে যে, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন’। তার মানে হলো সাধারণভাবে সংবিধান পাঠ করলে যে মনে হয় রাষ্ট্রপতি কোনো দন্ডপ্রাপ্ত আসামির দন্ড মওকুফ করে দিতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৪৯), তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১), তিনি প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগদান করেন (অনুচ্ছেদ ৬৪ ও ৯৫), কিংবা তিনি নির্বাচন কমিশন (অনুচ্ছেদ ১১৮), মহা হিসাব নিরীক্ষক (অনুচ্ছেদ ১২৭) বা কর্ম কমিশন প্রতিষ্ঠা ও নিয়োগের অধিকারী (অনুচ্ছেদ
১৩৭) তার কিছুই কার্যত স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।
অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুযায়ী ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের য়ে ক্ষমতা দিয়েছে তাও আসলে কথার মারপ্যাঁচ। এ ক্ষমতাও তার নয়, এ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের। ৫৬(৩) বলছে, ‘‘যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।’’ এটুকু পড়লেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতাই সংবিধান রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ করেনি।
তার মানে হলো ‘‘জনগণের মালিকানাধীন সকল ক্ষমতার একটি অংশ, প্রয়োগের বিধান বাহ্যত রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ, জনগণের হাতে নয়। কিন্তু ধোঁয়াশাটা এখানে শেষ নয়, রাষ্ট্রপতি জনগণের ক্ষমতার যে অংশটুকু চর্চা করেন বলে সাধারণভাবে ভ্রম হয়, তার প্রয়োগের আসল কর্তৃত্ব হলো প্রধানমন্ত্রীর। অর্থাৎ সংবিধান দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীর জন্য যতটুকু ক্ষমতা বরাদ্দ করেছে বলে মনে হয়, অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এর বদৌলতে তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি ভোগ করার অধিকারী। এখানে একটু দম নিলে মাথায় একটা প্রশ্ন আসে, সর্বজনশ্রদ্বেয় সংবিধান প্রণেতারা সাধারণ পাঠকদের জন্য এ ধোয়াশাটা কেন তৈরি করেছিলেন? একি শুধুই সংবিধানের সাহিত্যমূল্য বাড়ানোর জন্য, নাকি শুরু থেকেই জনগণের ব্যাপক অংশকে ধোকা দেয়ার জন্য?
নির্বাহী বিভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ হলো মন্ত্রীপরিষদ সংক্রান্ত। এখানে এসে সংবিধান, মূলত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত যাবতীয় ক্ষমতা এবং তার বাইরে যা কিছু নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে তার সবটুকুই প্রয়োগের ক্ষমতা তুলে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে (অনুচ্ছেদ ৫৫)। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ ও নিয়োগের অবসান, মন্ত্রীসভার আকার-আয়তন তার সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন [অনুচ্ছেদ ৫৬ (১) ও অনুচ্ছেদ ৫৮(২)]।
এইসব মন্ত্রী-উপমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ, আর অপসারণের বাইরে অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটি রয়েছে তাহলো জাতীয় সংসদ।জাতীয় সংসদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও সংসদের অপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
অনুচ্ছেদ ৫৫(৩) অনুযায়ী যদিও মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার কথা, কিন্তু অনুচ্ছেদ ৭০ দেখলেই বোঝা যায়, গোটা সংসদই দল তথা দলীয় প্রধানের কাছে দায়বদ্ধ শুধু নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ীই বাধ্য। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যখন যে ধরনের আইন প্রণয়নের নির্দেশ প্রধান করবেন জাতীয় সংসদ তখন সেই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য। কারণ অনুচ্ছেদ ৭০ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য যদি তার নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার সদস্যপদই বিলুপ্ত হবে (১৯৭২ সালের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব সদস্যপদ
বিলুপ্তির জন্য যে আদেশটি জারি করা হয়েছিল তা স্মর্তব্য)। আইন প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে না থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশও জারী করিয়ে নিতে পারেন। অনুচ্ছেদ ৭০-এর সঙ্গে অনুচ্ছেদ ১৪২ মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন, আর তার দল যদি জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন তাহলে তিনি সংবিধান সংশোধনের এমন অপরিমেয় ক্ষমতা ভোগ করবেন যা পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী কল্পনাও করতে পারে না। প্রসঙ্গক্রমে চতুর্থ সংশোধনী এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা এখানে সামান্য উল্লেখ করা যেতে পারে। অপরাপর সংশোধনের মধ্যে চতুর্থ সংশোধনীর একটি অনুচ্ছেদ ৩৪ এ বলা হয়েছিল, এ সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি আর রাষ্ট্রপতি থাকিবেন না, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন’ এবং তিনি রাষ্ট্রপতি পদের কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং ক্ষমতায় থাকিবেন যেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন। আর পঞ্চদশ সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৭-এর পরে ৭ক যোগ করে তার ১ (খ)-তে বলা হয়েছে : “এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করিলে, তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যাক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।”
’৭২-এর সংবিধান একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে ক্ষমতা অর্পণ করেছে পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান তো দূরের কথা, অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সেনা শাসকদের কাছেও এই পরিমাণ ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করার নজির নাই।
প্রজাতন্ত্রের অপরাপর ক্ষমতার ছিঁটেফোটাও কিভাবে লেপেপুছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তা পরবর্তী বিভিন্ন আলোচনা থেকে আরো পরিষ্কার হবে। তবে মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রের সকল প্রকার ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়ার যে ব্যবস্থা তার নাম রাখা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’
’৭২-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) যত উচ্চকণ্ঠেই ঘোষণা করুক না কেন যে জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক, কিন্তু এর প্রণেতা এবং এর প্রবক্তারা ভালো করেই জানেন যে, জনগণকে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ও নির্ধারিত পথে ভোট দেয়ার ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতারই মালিকানা দেয়া হয়নি।

রাষ্ট্র কী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অনুযায়ী চলে?
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম হলো ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’। এ ভাগের অনুচ্ছেদ ৮ থেকে অনুচ্ছেদ ২৫-এর মধ্যে পূর্বে উল্লেখিত, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এইসব নীতিসমূহের বিবরণ দিয়ে অনুচ্ছেদ ৮(২)-তে বলা হয়েছে: “এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবে। এই সংবিধান ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের

ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কাজের ভিত্তি হইবে...।” এ পর্যন্ত এসে একটু থামতে হবে; কারণ এরপরের অংশটুকুতে একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে মাঝে একটি ‘তবে’ দিয়ে। বলা হয়েছে, ‘তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না’। আপাত নির্দোষ ‘তবে’ যুক্ত এ শর্তটিকে সাধারণভাবে বেশ নিরীহই মনে হয় এবং খুব বেশি ‘ক্রিটিক্যাল’ না হলে এ নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা হওয়ারও কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি লক্ষ্য করেন রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে “সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে’’ (অনুচ্ছেদ ১০) বহাল থাকার পরও তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতার সাফাই গায়, কীভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে? একইভাবে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’ (অনুচ্ছেদ ১১)-এই অঙ্গীকার ছাপার অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকার পরও স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণ করে যে প্রশাসক নিযুক্ত করা হচ্ছে, সেটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?

উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবে জনগণ (অনুচ্ছেদ ১৩) এই নীতি বহাল থাকার পরও কিভাবে আদমজিসহ বড় বড় সকল কল-কারখানা  ব্যাংক-বীমা  ব্যক্তিমালিকদের কাছে তুলে দেয়া যায়? যদি কেউ তলিয়ে দেখতে চায় যে, যেখানে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো কৃষক-শ্রমিককে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া (অনুচ্ছেদ ১৪) সেখানে সবচাইতে বেশি বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের মুক্তি তো দূরের কথা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য খুন করা যায় কীভাবে?

“অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণ, যুক্তিসঙ্গত মজুরি, বিশ্রাম-বিনোদন ও অবকাশের অধিকার নিশ্চিত করা’’ (অনুচ্ছেদ ১৫)-রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হওয়ার পরও কীভাবে দেশের লক্ষ কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে? কীভাবে আশ্রয়হীন বস্তিবাসীকে বস্তি থেকেও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই উচ্ছেদ করা যায় এবং রাষ্ট্রকে তার জন্য কোথাও জবাবদিহি না করলেও চলে? তার সবকিছুর জবাবই দেয়া আছে ঐ আপাত নিরীহ ছোট “তবে” যুক্ত শর্তাংশটুকুর মধ্যে। “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ” অধ্যায়ে যেসব নীতির উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্র যদি তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথেও পরিচালিত হয় তবুও সাংবিধানিকভাবে তা প্রতিহত করার কোনো বিধান নেই।

সংবিধানের এই শুভঙ্করের ফাঁকি সম্পর্কে আমাদের বিশেষজ্ঞ-পন্ডিতরা যে কেবল নিশ্চুপমাত্র তা নয়, বরং সংবিধানের প্রণেতা বলে দাবিদারদের কেউ কেউ এই ফাকিকে আড়াল করার জন্য বলেন, দেশ সংবিধান অনুযায়ী চলছে না, তাই এমন হচ্ছে। বামপন্থী বলে দাবিদারদের কেউ কেউ বলেন, ’৭২ পরবর্তী সময়ে সংবিধান পরির্বতন করে তার মূলনীতি থেকে রাষ্ট্র সরে গেছে, তাই ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি।

কিন্তু সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদের শর্তটির সঙ্গে সংবিধানের অপর অংশগুলো মিলিয়ে পড়লেই দেখা যায়-দেশ সেভাবেই চলছে, যেভাবে চালানোর জন্য ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা, এর ভেতরে এইসব ‘তবে’ এবং এই তবের পক্ষে অপরাপর কায়দা-কানুন প্রবিষ্ট করিয়েছিলেন।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা বোধহয় খুবই কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে যে, ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার সংবিধানের এ অধ্যায়ের ৯ এবং ১০ অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’-কে নির্বাসন দিয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা পুনর্বহাল করেছে। এটা বোধহয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় কৌতুক হিসাবে স্বীকৃতি পাবে যদি কেউ দাবি করে যে, এইসব পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ন্যূনতম কোনো যোগসূত্র আছে।

মৌলিক অধিকারের ১৮টির মধ্যে ১৫টিই প্রচলিত আইনের হাতে বন্দি

সংবিধানের তৃতীয় ভাগ হলো মৌলিক অধিকার বিষয়ক। অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে অনুচ্ছেদ ৪৭ পর্যন্ত বিস্তৃত এ ভাগে ১৮টি অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া আছে। শুরুতে অনুচ্ছেদ ২৬-এ বলা হয়েছে, এই ভাগের বিধানাবলীর সঙ্গে প্রচলিত আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে এবং এইসব বিধানাবলীর সঙ্গে অসমঞ্জস কোনো আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করবে না, করলেও যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।

অনুচ্ছেদ ২৬ পড়ে যেকোনো পাঠকের মনে হতে পারে-সংবিধান মৌলিক অধিকারকে অন্তত নিরঙ্কুশ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পাঠক একটু সতর্ক হয়ে এগোলে দেখতে পাবেন, ‘আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান’, ‘ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’ বা ‘প্রত্যেকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে’ ইত্যাকার কয়েকটি বিষয় ছাড়া, বাকি যে সকল অধিকারকে সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেমন ‘চলাফেরার স্বাধীনতা’, ‘সমাবেশের স্বাধীনতা’, ‘সংগঠনের স্বাধীনতা’, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’, ‘পেশা-বৃত্তির স্বাধীনতা’ ইত্যাকার প্রায় সবগুলো অধিকারকেই প্রচলিত আইন,(অর্থাৎ পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী প্রণীত আইন ) নৈতিকতা, জনস্বার্থে আরোপিত বিধিনিষেধ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি শর্তের অধীনে বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং সে কারণে, অনুচ্ছেদ ২৬-এর ঘোষণা শুধু বাগাড়ম্বর ছাড়া আর অন্য কোনো ক্ষেত্রে  খুব একটা কাজে আসার কোনে কারণ নাই। ৭২-এর সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২৬ যতটুকু নিশ্চয়তা রেখেছিল, ৭৩ সালের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২৬(৩) যুক্ত করে তাও বাতিল করে দেয়া হয়।

অবশ্য এখানে অন্য কারণে অনুচ্ছেদ ৩৩-এর বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। অনুচ্ছেদ ৩৩-এ বলা হয়েছিল, কাউকে গ্রেপ্তার করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতের আদেশ ছাড়া কাউকে আটক রাখা যাবে না। ’৭৩ সালে আইনটি পরিবর্তনের প্রয়োজনবোধ করার পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী অনুচ্ছেদ ২৬-এ একটি সংশোধনী এনে ২৬(৩) যোগ করে বলে দেয়, “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের (সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত অধ্যায়) অধীন প্রণীত কোনো সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হইবে না’। অর্থাৎ ইতিপূর্বে অনুচ্ছেদ ২৬ পাঠ করে আমরা যে নিশ্চিত বোধ করেছিলাম যে, রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই ঘোষিত মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করতে পারবে না এবং মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোনো আইন যদি সংসদ প্রণয়নও করে তবুও তা বাতিল হয়ে যাবে, কিন্তু অনুচ্ছেদ ১৪২ সংবিধান সংশোধনের যে ক্ষমতা সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের হাতে দিয়েছে, তা প্রয়োগের বেলায় এ রক্ষাকবচ ধোপে টিকবে না। এই সংশোধনী ২৬(৩) যোগ করার অব্যবহিত পরেই ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলে দেয়া হয়, যদি কাউকে ‘নিবর্তনমূলক’ আইনে আটক করা হয়, তাহলে অনুচ্ছেদ ৩৩ প্রযোজ্য হবে না। আর এ সংশোধনীর পরে যখন ‘স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট-১৯৭৪’ প্রণয়ন করা হয়, তখন এই আইন যতই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী হোক না কেন অনুচ্ছেদ ২৬ কিংবা অনুচ্ছেদ ৩৩ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অবশ্য মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের আর একটি দিক প্রায় সবার কাছেই অনুল্লেখ্য থেকে যায় যে, এই অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৪৬-এ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ যদি কোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলারক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোনো কার্য করে তবে তাকে আইনের মাধ্যমে দায়মুক্ত করা যাবে। অর্থাৎ ‘শৃঙ্খলা রক্ষা’র জন্য যদি কাউকে হত্যাও করা হয়, তবু শৃৃঙ্খলা বাহিনীকে অব্যাহতি দিয়ে আইন প্রণয়ন করা যাবে। তখন আর আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, বা সকলেই আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকারী অথবা কাউকে আইনানুযায়ী ব্যতীত ‘জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা’ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না বলে যেসব অধিকার নিরঙ্কুশ ভাবা হয়েছিল, তা-ও আর নিরঙ্কুশ থাকে না। এইভাবেই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ‘অসমঞ্জস আইন বাতিল হয়ে যাবে’ অথবা ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা যাইবে না’, বক্তব্যসমূহ মিথ্যা, চাতুরিপূর্ণ ও ঠকবাজিতে পরিণত হয়।

সংবিধানের ষষ্ঠভাগের শিরোনাম হলো বিচার বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল-এ তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করে সংবিধান বিচার বিভাগের মূলনীতি প্রণয়ন করেছে। সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ৯৪(৪)-এ বলেছে-বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক, বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে স্বাধীন থাকবেন।
অনুচ্ছেদ-৯৫ তে বলা হয়েছে – রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শে অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ করবেন

করা যাবে না (অপসারণের এই বিধানটি হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্টের বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তি হওয়া উচিত এমন এক স্বৈরশাসকদের দ্বারা সংশোধিত হয়ে “সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল”-এর মাধ্যমে অপসারণের বিধানটি চালু করা হয়েছিল, সেই বিধানটি এখনো বহাল আছে)।
এ রকমভাবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত বিচারকদের কাছে রাষ্ট্রের অধস্তন আদালতসমূহের তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজনে পরামর্শ প্রদানের এখতিয়ার, পরামর্শ এবং তাদের নিজেদের তত্ত¡াবধানের জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা। এসব ক্ষমতার বাইরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে দেয়া হয়েছে অনুচ্ছেদ ১০২ অনুযায়ী, নাগকিদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এখতিয়ার।
’৭২-এর সংবিধান যদিও নির্দিষ্ট করে ঘোষণা করেনি, তবু সাধারণভাবে এদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সর্বোচ্চ আদালতই হলো সংবিধানের রক্ষক। বিচারকদের শপথনামা এবং অনুচ্ছেদ ৭(২)-কে ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করলে, এ দাবির যথার্থতা আছে বলা যায়। হাইকোর্ট/সুপ্রিম কোর্টের ঘোষিত আইনকে সকল অধস্তন আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় এবং প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী বিভাগ সুপ্রিম কোর্টকে সাহায্য করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং তার অধস্তন আদালতসমূহ মিলিয়ে যে বিচার ব্যবস্থা তা কিন্তু চলে সব ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া সেইসব আইনকে ভিত্তি করে, যে আইনসমূহের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছিল।
সংবিধান ঘোষিত জাতীয় সংস্কৃতি এবং ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ অনুচ্ছেদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ তা আচার-অনুষ্ঠান রীতি-নীতি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানের পরিত্যাক্ত আইন দিয়ে তথাকথিত বিচারকার্য পরিচালনা করে।
বিচারের আশায় আদালতে আশ্রয় নেয় যে দরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত মানুষ তাকে প্রথমেই দাঁড়াতে হয় সেই পুলিশের কাছে যে পুলিশ বাহিনী তৈরি করেছিল ব্রিটিশ ১৮৬১ সালে, দাঁড়াতে হয় সেই ১৮৬০ সালের দÐবিধি বা ১৮৬৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অথবা ১৯০৮সালের দেওয়ানী কার্যবিধি অনুযায়ী, যা তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা-যাতে করে দরিদ্র-অসহায়দের ক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্য একটি তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়ার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, আর রক্ষা করা যায় তার তাঁবেদার শ্রেণীকে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ীই রাষ্ট্র যখন যাকে ইচ্ছা তাকে মামলা থেকে রেহাই দিতে পারে। আর রাষ্ট্রপতি (প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী) পারেন বিচারে ফাঁসি হয়েছে এমন আসামিকেও মুক্ত করে দিতে। বিশদ আলোচনা করলে দেখা যেত-ব্রিটিশ বা পাকিস্তান পর্বেও আইন প্রণয়নকালে গণবিরোধী শক্তি তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য আইন প্রণয়নের সময়ে অন্তত যতটুকু ‘গণমুখী’ সাজার চেষ্টা করতো, আমাদের শাসকগোষ্ঠী তারও পরোয়া করে না, আমাদের স্বাধীনতার ৪২ বছরে প্রণীত আইনসমূহ উপনিবেশিক শাসকদের তুলনায় আরো অনেক বেশি গণবিরোধী, অমানবিক ও বৈষম্যমূলক। গুরুত্বের সঙ্গে যেটা দেখা এবং বোঝা দরকার তাহলো এই, ’৭২-এর সংবিধান এইসব মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন করা যাবে না বলে প্রথম অধ্যায়ে সদম্ভ ঘোষণা দিলেও অনুচ্ছেদে ১৪৯ আর ১৪২ শুধু এর পরিপন্থী নয়, ২৬(৩) হলো এর অনিবার্য সংযোজন আর মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে বর্ণিত প্রায় সকল অধিকার ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আরোপিত ঘেরাটোপের মধ্যে শুরু থেকেই বন্দী।
এইসব গণবিরোধী আইন দ্বারা গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগের কাছে যতবেশি স্বাধীনতা দেয়া হবে, এদেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের স্বাধীনতা তত বেশি বিপন্ন হবে আইন ও বিচারের মাধ্যমে। দুর্বল আর প্রবল, অত্যাচারী আর অত্যাচারিত, সম্পদ আত্মসাৎকারী আর সম্পদহীন আইনের চোখে সকলেই সমান এমন একটি অসামান্য মিথ্যাচারের ওপর দাঁড়ানো যে বিচারের দর্শন, যা অন্য যেকোনো পণ্যের চেয়ে সরলভাবে কিনতে পাওয়া যায় আর ব্যবহার করা যায় অত্যন্ত জটিল পন্থায়, বিচারের সেই পণ্য চরিত্র নিয়ে এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে পর্যন্ত কোনো ঘোষণা নাই। কেবল ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার’ অঙ্গীকার ছাড়া। সে অঙ্গীকার পূরণ হলে হতেও পারে, কিন্তু তাতে ন্যায়বিচার বলে যে প্রপঞ্চটি বাজারজাত করেন এখানকার পন্ডিত, বুদ্ধিজীবী আর সংবিধান প্রণেতারা তার কাছাকাছি পৌঁছা হবে না মানুষের।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যেসব সাংবিধানিক পদ রয়েছে তার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচাইতে কম আলোচিত, কম পরিচিত পদের নাম ‘মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক’। সংবিধানের অষ্টম ভাগের ৬টি অনুচ্ছেদের মাঝে (১২৭-১৩২) মহা হিসাব নিরীক্ষকের ক্ষমতা, কার্যাবলী, কর্মের মেয়াদ ইত্যাদির বিবরণ দেয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১২৭-এ বলা আছে রাষ্ট্রপতি একজনকে মহা হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ করবেন। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে এ পদেও তারই পছন্দসই একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিচারপতিদের অপসারণের যে ব্যবস্থা, মহা হিসাব নিরীক্ষক-এর জন্যও তাই প্রযোজ্য। তবে কর্ম অবসানের পর তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে অন্য কোনো পদে নিযুক্ত হতে পারবেন না।
প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব ইত্যাদির নিরীক্ষা এবং রিপোর্ট প্রদান তার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে (পড়ুন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে) তিনি যেরূপ নির্ধারণ করবেন, সেই আকার ও পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষিত হইবে।
এখানে এসে আমাদের নিজেদের বোঝাবোঝিটা ঝালাই করার জন্য আর একবার থামতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের যিনি প্রধান তিনি তার পছন্দসই লোকের মাধ্যমে তার পছন্দসই পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষা করবেন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা কথায় কথায় যেসব দেশের উদাহরণ দিতে খুব পছন্দ করেন তারাও অন্তত এ পদে বিরোধীদলের কাউকে না কাউকে বসিয়ে থাকেন।
আমাদের সংবিধান তার বদলে উপরে কথিত পদ্ধতিতে রক্ষিত হিসাব সম্পর্কিত রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করার বিধান করেছে এবং বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করিবেন।
সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধিতে (সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ে এ পরিসরে আলোচনা করার সুযোগ নাই, অন্যথায় দেখা যেত সংসদকে যেরকম ঢালাওভাবে আলোচনার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বিষয়টি মোটেও তেমন সহজ নয়। সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধিতে সংসদ প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তাতে তার আনুক‚ল্য ছাড়া কোনো বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব) অবশ্য সরকারি হিসাব সম্পর্কিত একটি স্থায়ী কমিটি করার বিধান রয়েছে। সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধির ২৩৩-এ অন্যান্যের মধ্যে বলা হয়েছে উক্ত কমিটি সরকারের বার্ষিক আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করবে এবং কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়ম পরীক্ষা করে তা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ-সহ সংসদে রিপোর্ট পেশ করবে। এখানে সংসদীয় কমিটির যে ক্ষমতা তা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কমিটি ত্রূটি-বিচ্যুতি-অনিয়ম দূর করার সুপারিশ করার অধিকারী মাত্র, ত্রæটি-বিচ্যুতি-অনিয়মকারীদের শাস্তি দেওয়া তো দুরের কথা এদের শাস্তির সুপারিশ করার এখতিয়ারও নেই এই কমিটির।
এইভাবে রাষ্ট্রীয় তহবিল লুটপাটের ব্যবস্থাকে শাস্তির উর্ধ্বে নিরঙ্কুশ করার জন্য যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি এখানে গড়ে তোলা হয়েছে তাকে নিয়ে কোনো বুদ্ধিজীবী কখনো প্রশ্ন তুলেছে বলে মনে পড়ে না।
এইসব বিষয় আলোচনার বা উল্লেখের প্রয়োজন হলো এ জন্য যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যে দেশ দুর্নীতির জন্য লাগাতার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ চুক্তি প্রত্যাহার করেছে, যে দেশের কমবেশি প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ-সংস্কৃতিকর্মী মায় সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত একমত যে, এদেশের সম্পদশালীদের অধিকাংশই সরকারি সম্পত্তি, ব্যাংক-বীমা-বাণিজ্য ইত্যাদি আত্মসাতের মধ্যদিয়ে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
এই আত্মসাৎকরণের হিসাব-কিতাব রক্ষণ, পর্যবেক্ষণ এবং অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি আবিষ্কারের পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যে বিধান তার চেহারা যদি এরকম হয়, তাহলে এইসব আত্মসাৎ বন্ধের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা না করলেও চলে।
মহা হিসাব নিরীক্ষক বিগত ৪২ বছরে বাংলাদেশের সরকারি তহবিল এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব কিতাব পর্যালোচনা করে তেমন কোনো বড় গড়মিল আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নাই। আর গড়মিল আবিষ্কার করতে পারলেও তা দূর করার যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তা বলাই বাহুল্য।
আমাদের মহা হিসাব নিরীক্ষক এবং রাষ্ট্রপতি (প্রধানমন্ত্রী) মিলে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় হিসাবরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য যেসব বিধিবিধান তৈরি করেছেন তা এমন প্রকৃতির যাতে ছোটখাটো ২-১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ধরা পড়লেও পড়তে পারে কিন্তু রুই-কাতলারা ধরা পড়ার কোনো ব্যবস্থাই নাই।
মূলত সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ, লুটপাট বন্ধের ব্যবস্থা না করে, যত বড় বড় বাজেট, যত বড় উন্নয়ন প্রকল্প, যত বেশি করারোপ, যত বেশি স্থাপনা তৈরির ব্যবস্থা হবে, তত বেশি বৈষম্য, তত বেশি সম্পদের পুঞ্জীভবন, ততবেশি নিঃস্বকরণ ও তত বেশি অনুপার্জিত সম্পদ ভোগের ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ হবে। ’৭২-এর সংবিধান মুখে (ভূমিকা আর মূলনীতি) যা-ই বলুক কার্যত তার বিপরীতটা করার উপযোগী পথটাই তৈরি করে দিয়েছে।

সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে’ ‘জনগণের ক্ষমতা চর্চা-র সবচেয়ে বড় তিন প্রতিষ্ঠানের একটি হলো সংসদ। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের।
সংবিধানের পঞ্চম ভাগের শিরোনামই হলো ‘আইনসভা’। এই ভাগের দুটি পরিচ্ছেদ। প্রথম পরিচ্ছেদে সংসদের নাম, সংসদ কোথায় বসবে, সংসদ সদস্য হওয়া ও থাকার যোগ্যতা, বেতন ভাতা, সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি ইত্যাদি; আর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতির দিক-নির্দেশনা দেয়া আছে।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভা যে চূড়ান্ত স্বাধীন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬(২) যে সেক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সেটা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। সংবিধানে এ বিষয়ে আরো অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, যদিও তা বিদ্যমান বা প্রচলিত আইন বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবুও একটু দেখে নেয়া যেতে পারে-অনুচ্ছেদ ৭(২), যেখানে বলা হয়েছে: “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয় তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।”
লক্ষণীয় হলো, আজ পর্যন্ত ব্রিটিশ, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের কোনো আইনই সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস বিবেচিত হয়নি। তার দুইটি অর্থ হতে পারে; এক. বাংলাদেশের যে সংবিধান তা কোনোভাবেই ব্রিটিশ, পাকিস্তানের আইনসমূহের চেয়ে অগ্রসর কোনো অবস্থান নেয়নি অথবা দুই, ব্রিটিশ বা পাকিস্তান পর্বে কোনো গণবিরোধী আইন-কানুন হয়নি বা ছিল না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা প্রত্যেকেই আমাদের চেয়ে ভালো জানেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অবস্থা যা-ই হোক, বাংলাদেশের আইনসভা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সরকার যে কোনো আইনই প্রণয়ন করতে পারে, আর যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তাহলে যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সংবিধানকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে এবং এ সংবিধানটিকে এভাবে কতদূর পর্যন্ত বদলে দেয়া যায়, তার নমুনা দেখতে হলে, চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনীগুলো দেখাই যথেষ্ট।
এত ক্ষমতা যে সংসদের , যার সংখ্যাগরিষ্ঠরা চাইলেই জারি করে দিতে পারে বিশেষ ক্ষমতা আইন ’৭৪, সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল আইন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন-১৯৭৫, বিনিয়োগ বোর্ড আইন-১৯৮৯, সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন (বিশেষ) আইন-১৯৯৪, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রæত বিচার) আইন-২০০২, যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এত ক্ষমতা দিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেনি সংবিধান প্রণেতারা। তারা আরও অধিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছিল অনুচ্ছেদ ৮০ (৩)-এ। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের যে ক্ষমতা, বৈষম্যের মূল বীজটি নিহিত আছে যেখানে, সংবিধান সেই স্থানটিকে সিলগালা করে দিয়েছে এই বলে যে, ‘রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তাহার নিকট পেশ করিবার সময়ে প্রত্যেক অর্থবিলে স্পীকারের স্বাক্ষরে এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট থাকিবে যে, তাহা একটি অর্থবিল এবং অনুরূপ সার্টিফিকেট সকল বিষয়ে চূড়ান্ত হইবে এবং সেই সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
লক্ষণীয়, সংবিধান রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়কে যে ভাষায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, আইন আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিরঙ্কুশ করেছে তেমন ভাষা আর কোনো বিষয়েই ব্যবহার করেনি, না কারো জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নেও না।
সংবিধান ‘আইন প্রণয়ন ও অর্থ-সংক্রান্ত পদ্ধতি’ পরিচ্ছেদে অনুচ্ছেদ ৮০ থেকে অনুচ্ছেদ ৯০-র মধ্যে অর্থ বিল, বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি (বাজেট) বার্ষিক বিবৃতির পদ্ধতি ইত্যাদির আলোচনা করেছেন।
অনুচ্ছেদ ৮০-তে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে-প্রতিটি আইন সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সংসদ কর্তৃক পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হবে এবং অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে তিনি বিলের কোনো বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনা কিংবা কোন সংশোধনী বিবেচনার জন্য সংসদে পাঠাতে পারবেন । সংসদ এক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিবেচনাসহ বা বিবেচনা ছাড়া বিলটি পুনরায় পাস করে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করলে তিনি স্বাক্ষর করুক বা না করুক নির্দিষ্ট সময় পরে বিলটি আইনে পরিণত হবে। অনুচ্ছেদ ৮০-তে আইন প্রণয়নের যে প্রক্রিয়া তাতে সংসদ স্বাধীন, একচ্ছত্র। রাষ্ট্রপতি বড়জোড় তা পুনর্র্বিবেচনার অনুরোধ করার ক্ষমতাসম্পন্ন, কিন্তু অর্থবিল ব্যতীত, অর্থাৎ যা অর্থবিল যেখানে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত সেখানে অন্য কারো তো প্রশ্নই উঠে না, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধও করতে পারে না।
অনুচ্ছেদ ৮১-তে অর্থ বিল বলতে যে কর আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ বা রহিতকরণ, সরকারের ঋণগ্রহণ বা গ্যারান্টিদান, সরকারের আর্থিক দায়-দায়িত্ব আইন সংশোধন এবং সরকারি অন্যান্য তহবিলের রক্ষণাবেক্ষণ অর্থদান ইত্যাদি বোঝায় তার যাবতীয় বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। ৮০(৩) অনুচ্ছেদে এসে সংবিধান পরিষ্কারভাবে একটি বিষয় ঘোষণা করেছে যে, “রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তাঁহার নিকট পেশ করিবার সময়ে প্রত্যেক অর্থবিলে স্পীকারের স্বাক্ষরে এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট থাকিবে যে, তাহা একটি অর্থবিল এবং অনুরূপ সার্টিফিকেট সকল বিষয়ে চূড়ান্ত হইবে এবং সেই সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’’
অর্থাৎ কিনা রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশে যতই বলা হোক না কেন “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টন প্রণালী সমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবে জনগণ’’ যতই বলা হোক না কেন “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” যতই “অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা”সহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হোক না কেন, যতই দাবি করা হোক না কেন যে, “নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন আর অনুপার্জিত আয় ভোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে”, যতই “আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র এইসব নীতি প্রয়োগ করবে বলে অঙ্গীকার” পুনর্ব্যক্ত করুক না কেন, অনুচ্ছেদ ৮(১)-এর শর্তাংশ “তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়” এবং অনুচ্ছেদ ৮০(৩)-এর “এবং সেই সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না”, শর্ত দুটিকে এক সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে যেকোনো পাঠকেরই উপলব্ধি করার কথাÑরাষ্ট্রের আয়-ব্যয় আর রাষ্ট্রের বণ্টন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার ’৭২-এর সংবিধান কাউকে দেয়নি।
এটা খুব সহজেই বুঝতে পারার কথা যে, লুটপাটের অর্থনীতির বিরুদ্বে ’৭২-র সংবিধান কখনোই দাঁড়াতে চায়নি। যারা মনে করে ’৭২-এর সংবিধানের সঙ্গে নিঃস্বকরণ, বৈষম্যবৃদ্ধি আর লুটপাটের অর্থনীতির একটা বিরোধ আছে, তারা যে একটা খুব বড় ধরনের ধোঁয়াশার পেছনে ছোটার সাধারণ ভুল করেন, এটা স্পষ্ট।
দেশের মোট সম্পদের ৯০ ভাগের মালিক যে ১০ ভাগ মানুষ তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ‘কর’ মিলিয়ে কত টাকা রাষ্ট্রকে প্রদান করে, আর কত টাকা রাষ্ট্র তাদের পেছনে খরচ করে অথবা দেশের ১০ ভাগ সম্পদের মালিক যে ৯০ ভাগ মানুষ রাষ্ট্র কত টাকা তাদের কাছ থেকে তুলে নেয়, আর কত টাকা তাদের পেছনে খরচ করে? দেশের কৃষক, কৃষকের সন্তান ‘অভিবাসী শ্রমিক’ আর দিনমজুরদের কিশোরী ‘গার্মেন্টস কর্মী-রা মিলে রাষ্ট্রের মোট আয়ের কতটুকুর যোগান দেয়, আর রাষ্ট্র সেই যোগান কীভাবে, কাদের পেছনে খরচ করে? রাষ্ট্রের এই যে আয়-ব্যয়ের অর্থনীতি, তার যে আইন-কাঠামো, সংবিধান সেই অর্থনীতির আইনি কাঠামোকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে রেখেছে। এটুকু না বোঝে যারা ’৭২-এর সংবিধানকে জনগণের বৈষম্য হ্রাসের সংবিধান মনে করে এর পেছনে ছোটেন, তারা ’৭২-এর সংবিধান পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বৈষম্য আর লুটপাট বন্ধের সংবিধানের দেখা পাবেন না।

সাধারণভাবে আমাদের সংবিধান প্রণেতাগণ, সুশীল সমাজ, “গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে” বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের আদর্শে উজ্জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সংবিধানসম্মত ক্ষমতা চর্চার পথ বলতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার গঠন করে ক্ষমতা চর্চার পথকেই বোঝেন। জনগণ যে সার্বভৌম, তাদের অভিপ্রায়ই যে সংবিধান এবং প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হিসাবে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের একমাত্র পথই হলো নির্বাচন-এটাও তাদের বিশ্বাস হিসাবে আছে। সংবিধান এই নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের পথ নির্দেশ করেছে সপ্তম ভাগে।
সংবিধানের সপ্তম ভাগের ‘নির্বাচন’ শিরোনামের অধ্যায়টিতে ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদের মধ্যে কমিশনের গঠন, দায়িত্ব, ভোটারের যোগ্যতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়, কমিশনের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কর্তব্যের বিবরণ দেয়া আছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি (পৌনঃপুনিকতর ঝুঁকি নিয়ে বলতে হচ্ছে পড়ুন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শমতে) সময়ে সময়ে যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ সদস্য সংখ্যার কমিশনার নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচনকালীন নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন) নির্বাচন কমিশনকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে এবং এইসব কমিশনার নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বাইরে যে সব সাধারণ যোগ্যতার বিবরণ দেয়া আছে তা পাঠ করলেই যে কোনো পাঠকের বোঝার কথা নির্বাচন কমিশন বা কমিশনারদের নিয়োগের জন্য আনুগত্যের বাইরে আর কোনো বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন নাই।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংবিধানের এ কয়েকটি অনুচ্ছেদের বাইরে বেশ কয়েকটি সহায়ক আইন যেমন: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২, সংশোধিত আদেশ ২০০৯, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা-২০০৮, সংসদ সদস্য (বিরোধ নিষ্পত্তি) আইন-১৯৮০, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা-২০০৮, সংসদীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০০৮ ইত্যাদি ছাড়াও ভোটার তালিকা আইন, বিধিমালা, স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রার্থীতার পক্ষে সমর্থন যাচাই) বিধিমালা-২০১১ ইত্যাদি বহাল আছে।
এইসব আইন প্রণয়ন ও সঠিক বাস্তবায়নের জন্য যে উদ্দেশ্যের কথা বলা হয় তাহলো, জনগণ (তাদের মুখের ভাষায় প্রজাতন্ত্রের মালিকগণ) যাতে নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে, প্রশাসন যাতে কারো প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলতে সক্ষম না হয় এবং প্রার্থীরা যেন অবাধে যত ইচ্ছা তত কালো টাকা/সাদা টাকা খরচ করে ভোট কিনে না নিতে পারেÑতার নিশ্চয়তা বিধান করা। এইসব বিধানের আরও লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর যেন অন্তত একবার ভোটের ব্যবস্থা হয়। ভোটের মেয়াদ শেষে যাতে কেউ পুনর্বার নির্বাচিত হওয়া ছাড়া ক্ষমতা আঁকড়ে না রাখতে পারে।
বলাবাহুল্য, গোটা সংবিধানে এইভাবে ভোটের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য কাউকে মনোনীত করার জন্য ভোট প্রদানের সুযোগ ছাড়া আর কোথাও অন্য কোনোভাবে প্রজাতন্ত্রের মালিকদের (জনগণ), মালিকানা প্রকাশ কিংবা চর্চার সুযোগ দেয়া হয়নি।
এমনকি যাকে একবার মনোনীত করা হয়েছে ৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার একদিন আগেও তার এই মনোনয়ন বাতিলের বা পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ এই ‘সংবিধান’, যাদের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ, তাদের জন্য রাখেনি। তবে জনগণের হাতে এ ক্ষমতা না থাকলেও আইন প্রণয়ন করার জন্য যার হাতে অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে সংবিধান, অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণী ও আইন প্রণয়নে যাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ, যাদের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার জন্য তারা সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন, তাদের আয়ুষ্কাল কতদিন হবে তা নির্ভর করে দলের যিনি প্রধান, যে দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। সংবিধানের ৭০ অন্ুেচ্ছদ এটা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, কোনো সংসদ সদস্য যদি দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তবে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। জনগণের বিপক্ষে কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিপক্ষে ভোট দিলে কিন্তু সদস্যপদ কখনোই যাবে না।
সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, এ সংবিধান যদিও এদেশকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং এর চার মূলনীতির অন্যতম হিসাবে গণতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু যে নির্বাচন পদ্ধতি সে বহাল এবং চালু করতে চেয়েছে, তা ‘প্রজাতন্ত্র’ আর সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের যে ধারণা তার সঙ্গে সংগতিসম্পন্ন কি-না, তা কখনো পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি।
এটা প্রায় প্রত্যেকেরই জানা আছে, আমাদের বহুদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটাও প্রায় সবাই জানেন যে, এ পর্যন্ত এদেশ যেসব রাজনৈতিক দল শাসন করেছে, তাদের কারো জন্য কখনো ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়া অবধারিত ছিল না, পায়ও নি।

সবসময়ই ৩০-৪০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তরা, বাকি ৬০-৭০ ভাগ মানুষদের শাসন করছে। বরাবরই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক শাসিত হয়েছে সংখ্যালঘিষ্ঠদের হাতে। তারচেয়েও বড় সত্য হলো, প্রজাতন্ত্রের “মালিকদের” ৬০ বা ৭০ শতাংশ মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনায় তথাকথিত প্রতিনিধির মাধ্যমেও অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং আমাদের সংবিধান প্রণেতারা কখনোই এ ৬০-৭০ শতাংশ ‘মালিকদের’ রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার করার দায়িত্বের কথা অনুচ্ছেদ ৭(১)-এ লিখে রাখা ছাড়া অন্য কোনোভাবে পূরণের দায়বোধ করেননি।
তথাকথিত অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধানে বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে নতুন ব্যবস্থা চালু এবং তা পরখ করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত এ সংক্রান্ত বিতর্কে জড়িয়ে দেশের জনগণের, বিচার বিভাগের এবং রাজনীতির মধ্যে একটি লেজে-গোবরে অবস্থা তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতদের প্রায় কেউ এ প্রশ্নটা তোলারও প্রয়োজনবোধ করেছেন না যে, প্রজাতন্ত্রের ৬০-৭০ শতাংশ মালিকের ভোট কোন শুভঙ্করের হিসাবে বুদবুদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে বারবার? কীভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছে?
প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের যেমন ভোট প্রদানের অধিকার রয়েছে, তেমনি তাদের প্রত্যেকের ভোটের অনুপাতে দেশ পরিচালনায় তাদের প্রতিনিধি মনোনয়নের অধিকারও এ দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। অন্যান্য সকল আইনে যেমন, এজেন্ট বা প্রতিনিধি বা অ্যাটর্নিকে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য অপসারণের বিধান রয়েছে-জনপ্রতিনিধিও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহার করার অধিকার যদি প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিকদের না থাকে, তবে জনগণ কিছুতেই দেশের ‘মালিক’ নয় আর জনপ্রতিনিধিরাও কারো ‘প্রতিনিধি’ নয়।

১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৩ থেকে ১৩৬ পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত অসামরিক কর্মচারীদের নিয়োগ, কর্মের মেয়াদ, কর্মচারীদের বরখাস্ত ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করেছে। আর অনুচ্ছেদ ১৩৭ থেকে ১৪১ পর্যন্ত কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠা, কর্মকমিশনের ক্ষমতা, দায়িত্ব ইত্যাদি নির্ধারণ করেছে। এখানে পুনরায় উল্লেখ করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। তবে সত্য হলো, অন্যান্য কমিশনের মতো বাংলাদেশের কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং অপরাপর সদস্যগণ নিযুক্ত হবেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। তাদের কার্যাবলী নির্ধারিত হবে প্রেসিডেন্টের আদেশ অনুযায়ী আর তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-পরিচালনা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করবেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদান ছাড়াও তাদের পদোন্নতি, বদলি, কর্মের শৃঙ্খলা ইত্যাদি নির্ধারণের দায়িত্ব এই কমিশনের।
সামরিক কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের বিষয়ে সংবিধানে আলাদা কোনো অধ্যায় বা ভাগ নাই, বরং রাষ্ট্রপতি বিষয়ে সংবিধানের ৪র্থ ভাগে যেসব পরিচ্ছেদ আছে তার ৪র্থ পরিচ্ছেদটির শিরোনাম হলো-প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ। এ পরিচ্ছেদে মাত্র তিনটি অনুচ্ছেদ আছে। অনুচ্ছেদ ৬১-তে সর্বাধিনায়কতা, ৬২-তে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগে ভর্তি প্রভৃতি এবং ৬৩-তে যুদ্ধ। ৬১-তে বলা হয়েছে-প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হইবে এবং আইনের দ্বারা তাহার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হইবে।
এখানে আইন বলতে সামান্য হেরফের-সহ আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২, এয়ারফোর্স অ্যাক্ট ১৯৫৩, নেভি অর্ডিন্যান্স ১৯৬১সহ অপরাপর (ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি) আইন ও বিধিসমূহের কথাই বলা হয়েছে।
যদিও অনুচ্ছেদ ৬২-তে বলা হয়েছেÑসংসদ আইনের দ্বারা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ ও উক্ত কর্মবিভাগ সমূহের সংরক্ষিত অংশ গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মবিভাগসমূহে মঞ্জুরি, প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধানদের নিয়োগ, বেতন-ভাতা এবং উক্ত বিভাগসমূহের শৃঙ্খলামূলক ও অন্যান্য বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ করবে; তবে উপধারা ২ ও ৩-এ বলা হয়েছে, উপরোক্ত বিষয়সমূহের জন্য বিধান না করা পর্যন্ত (এ রকম বিধান করার কথা অনেকক্ষেত্রে বলা আছে কিন্তু এ বিধান কতদিনের মধ্যে করতে হবে তার বাধ্যবাধকতা নির্ধারিত না হওয়ায় বিগত ৪২ বছরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয় নি) এবং প্রচলিত আইনের মধ্যে পড়ে না এমন বিষয়ে রাষ্ট্রপতি (প্রধানমন্ত্রীর উপদেশমতো) আদেশের দ্বারা বিধান করিতে পারিবেন। অর্থাৎ এখানেও ক্ষমতা মূলত প্রধানমন্ত্রীর হাতেই। ৬৩-তে বলা হয়েছে সংসদের সম্মতি ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না।
এ বিষয়ে সবার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করা জরুরি তাহলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সংবিধান অনেক বিষয়ে তার নীতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতি বা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান কি তার উল্লেখ কোথাও নাই।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেলায় অনুচ্ছেদ ২১(২)-তে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের প্রতি কি রূপ আচরণ করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য, তার কোনো রূপরেখা, সংবিধানের কোথাও আলাদাভাবে উল্লেখিত বা উচ্চারিত হয়নি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২-তে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’-এর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে সামরিক-অসামরিকের মধ্যে কোনো বিভাজন করা হয়নি। কিন্তু মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৪৬ নং অনুচ্ছেদে সামরিক কর্মে নিযুক্তরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কোনো অঞ্চলের ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের’ প্রয়োজনে কোনো কর্ম করে থাকলে সংসদ আইনের দ্বারা সেইসব ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করে আইন প্রণয়ন করতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
ইতিপূর্বে আমরা যতটুকু আলোচনা করেছি তা থেকে এটা স্পষ্ট, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বা অন্য কোথাও রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গীকার থাকা মানেই রাষ্ট্র তা বাস্তবায়নে বাধ্য, এমন নয়; এমনকি মূলনীতিতে যা বলা আছে, অনেক ক্ষেত্রে তার বিপরীতে চলার ব্যবস্থা সংবিধানই করে রেখেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, সংবিধান প্রণেতা বা তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী যখন দেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিরক্ষা বাহিনী নাই বললেই চলে বা যখন দেশের আপামর মানুষ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুবক পর্যন্ত দেশের জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, যাদের দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের স্পৃহা সীমাহীন, এরকম একটি সময়ে দেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় দেশের অধিকাংশ মানুষকে যুক্ত করার বদলে কেন শুধুই ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি কায়দায় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা এবং রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনা করেছিল তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। নিশ্চয়ই তার বিপুল রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে কিন্তু এসবের পেছনে যে চিন্তাই থাকুক না কেন, তা যে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই সামরিক শক্তিকে জনগণের বাইরের এবং একটু উপরের স্তরে বসানোর চিন্তা তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এসবের অদৃশ্য ফল বা সুদূরপ্রসারী অভিঘাত যা-ই হোক না কেন, আমাদের দৃশ্যমান ফল বা অভিজ্ঞতা যা, তাহলো এই যে, অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, আর প্রতিপক্ষকে সামরিক আদালতে ফাঁসির মঞ্চে চড়ানোর মধ্যদিয়ে জনগণের টাকায় গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বারংবার নৈতিক এবং ব্যবহারকি ক্ষেত্রে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করা হয়েছে।
আমাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধারণা নিয়ে খুবই বিশদ এবং বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। এ পরিসরে শুধু এটুকু বলে রাখা জরুরি, প্রচলিত বা সনাতন চিন্তায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায় এবং প্রতিরক্ষার যে ধারণা আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মাথায় কাজ করে বর্তমান বিশ্বে তা প্রায় অচল। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের সামরিক দর্শন ও অনুশীলন আজকের যুগে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। একে কোনোভাবেই যুগোপযোগী বলা যায় না। বর্তমানে প্রতিরক্ষা ভাবনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে পানি-নিরাপত্তা, জ্বালানি-নিরাপত্তা, খাদ্য-নিরাপত্তাসহ অপরাপর অসামরিক বিষয়।
শুধু পানি বা জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্ন যদি আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম না হই, তাহলে আমাদের জাতির পক্ষে যতটুকু ব্যয় বহন করা সম্ভব তার সবটুকু দিয়েও যদি সামরিক শক্তি গড়ে তোলা হয় তবুও তার দ্বারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হবে না। আর সামরিক নিরাপত্তার প্রশ্নেও যদি একটু চোখ কান খোলা রেখে চিন্তা করা যায় তাহলে এটা খুব সহজেই দেখা সম্ভব, যারা আমাদের নিরাপত্তার জন্য সাধারণ হুমকি বলে বিবেচিত হতে পারে (সামরিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) সেগুলোর মোকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি গড়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব কল্পনা। সেক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ জনগণকে দেশপ্রেম ও প্রাথমিক সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যে যুগোপযোগী এবং শক্তিশালী করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার আমাদের শাসকেরা করে থাকেন তা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না। ’৭২-এর সংবিধান বা তার পরবর্তী কোনো সংশোধনীই আমাদের রাষ্ট্রের এই মৌলিক ত্রুটি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা চিন্তাও করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *